ভগবান শিবের পূজা করার সময় আপনি নিশ্চয়ই মন্দিরগুলিতে নন্দীর মূর্তি তাঁর ঠিক সামনে বসে থাকতে দেখেছেন। নন্দী শুধু শিবের বাহনই নন, বরং তাঁর সবচেয়ে কাছের ভক্ত এবং সেবক হিসেবেও বিবেচিত হন। বলা হয়, শিব যেখানে থাকবেন, সেখানে নন্দী অবশ্যই থাকবেন। এই কারণেই শিব মন্দিরে প্রবেশ করার আগে ভক্তরা নন্দীকে প্রণাম করেন।
মনস্কামনা নন্দীর কানে বলার পরম্পরা
শিব ভক্তদের মধ্যে এই পরম্পরা বেশ প্রচলিত যে, যা ইচ্ছা হোক, তা নন্দীর কানে বলা উচিত। বিশ্বাস করা হয় যে, যদি নন্দীর কানে মনের কথা বলা হয়, তবে তা সরাসরি ভগবান শিবের কাছে পৌঁছয়। এটা শুধু একটি পরম্পরা নয়, বরং বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত একটি পৌরাণিক বিশ্বাস, যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।
শিবের সাধনায় মগ্নতা এবং নন্দীর ভূমিকা
ভগবান শিবকে ধ্যান ও সমাধিতে মগ্ন দেবতা হিসেবে মানা হয়। তিনি প্রায়শই তপস্যায় ডুবে থাকেন। এমন পরিস্থিতিতে ভক্তদের আওয়াজ বা প্রার্থনা তৎক্ষণাৎ তাঁর কাছে নাও পৌঁছতে পারে, তাই নন্দীকে মাধ্যম হিসেবে ধরা হয়। নন্দী সবসময় শিবের দিকে মুখ করে বসে থাকেন এবং সম্পূর্ণ শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর সেবায় লেগে থাকেন। এটাই কারণ যে লোকেরা মনে করে, নন্দীকে যা বলা হবে, তা নিশ্চিতভাবে শিবের কাছে পৌঁছে যাবে।
নন্দীকে শিবের সবচেয়ে বড় ভক্ত কেন মানা হয়
একটি বিশ্বাস অনুযায়ী, যখন সমুদ্র মন্থন হয়েছিল এবং তা থেকে যে বিষ নির্গত হয়েছিল, তা পুরো ব্রহ্মাণ্ডকে ধ্বংস করতে উদ্যত ছিল, তখন ভগবান শিব তা পান করেছিলেন। কথিত আছে, সেই সময় বিষের কিছু ফোঁটা মাটিতেও পড়েছিল, যা নন্দী দ্বিধা ছাড়াই পান করেছিলেন। নন্দীর এই সমর্পণ দেখে শিব অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছিলেন এবং তাঁকে নিজের সবচেয়ে প্রিয় ভক্ত ঘোষণা করেছিলেন। তখন থেকেই নন্দীকে শিবের পরম ভক্ত বলা হতে থাকে।
নন্দীর জন্মের কাহিনীও বেশ আকর্ষণীয়
আরেকটি পৌরাণিক কাহিনীতে বলা হয়েছে যে, ঋষি শিলাদ কঠোর তপস্যা করে ভগবান শিবের কাছে একটি সন্তান চেয়েছিলেন। শিব তাঁকে নন্দীর বর দেন। নন্দী শৈশব থেকেই বেদ ও পুরাণের জ্ঞানী হয়ে ওঠেন। একদিন কিছু সাধু নন্দীর অল্প বয়সে মারা যাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেন। এটা শুনে নন্দী শিবের তপস্যা শুরু করে দেন। শিব তাঁর ভক্তিতে প্রসন্ন হয়ে তাঁকে অমরত্বের বর দেন এবং তাঁকে নিজের বাহন হিসেবে ঘোষণা করেন।
কৈলাসের প্রহরী এবং ভক্তদের বার্তাবাহক
নন্দী শুধু শিবের বাহন নন, বরং কৈলাস পর্বতের দ্বারপালও। তিনি শিবের দরবারে বিশেষ স্থান পান। ভক্তদের বিশ্বাস, যদি তারা নন্দীর কাছে তাঁদের মনস্কামনা বলেন, তবে তিনি তা সততার সঙ্গে এবং সম্পূর্ণ শ্রদ্ধার সঙ্গে শিবের কাছে পৌঁছে দেন। নন্দী ভক্ত এবং শিবের মধ্যে একটি সেতুর মতো কাজ করেন।
মনস্কামনা বলার নিয়মও বিশেষ
ভক্তরা যখন মন্দিরে নন্দীর মূর্তির কাছে পৌঁছন, তখন সেখানে কিছু বিশেষ নিয়ম পালন করে নিজের কথা বলেন।
- প্রথমত নন্দীর মূর্তির কাছে পৌঁছে হাত জোড় করে প্রণাম করতে হয়।
- এরপর, ‘ওঁ’ উচ্চারণ করে মনকে শান্ত করতে হয়।
- মনস্কামনা খুব আস্তে নন্দীর বাঁ কানে বলতে হয়, যাতে অন্য কেউ তা শুনতে না পায়।
- কিছু ভক্ত তাঁদের ঠোঁট দুটি হাত দিয়ে ঢেকে মনস্কামনা বলেন, যাতে তা সম্পূর্ণরূপে গোপন থাকে।
- মনস্কামনা বলার আগে নন্দীর পূজা ও আরতি করাও শুভ বলে মনে করা হয়।
প্রতিটি শিব মন্দিরে কেন নন্দীর মূর্তি থাকে
শিব মন্দিরগুলোতে নন্দীর মূর্তি ভগবান শিবের ঠিক সামনে স্থাপন করা হয়। এই স্থানটি এটাই দেখায় যে, নন্দী সবসময় তাঁর প্রভুর দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। যখন ভক্তরা মন্দিরে শিবের দর্শন করেন, তখন প্রথমে নন্দীর দর্শন করে তাঁকে নিজের কথা বলেন। এই পরম্পরা ভারতের প্রায় প্রতিটি শিব মন্দিরেই দেখতে পাওয়া যায়।
নন্দীর নাম কেন এত শ্রদ্ধার সঙ্গে নেওয়া হয়
নন্দী শুধু একটি পৌরাণিক চরিত্র নন, বরং ভক্তদের আস্থা ও শ্রদ্ধার প্রতীক। তাঁকে দেখে লোকেরা নিঃস্বার্থ সেবা ও ভক্তির প্রেরণা পায়। নন্দীর ভক্তি এতটাই যে তিনি সবসময় একই ভঙ্গিতে বসে থাকেন, শুধু তাঁর প্রভু শিবের দিকে তাকিয়ে। তিনি না এদিকে দেখেন, না ওদিকে। শুধু ভগবান শিব এবং তাঁর সেবাই তাঁর জীবনের লক্ষ্য।
নন্দীর মাধ্যমে ভক্তরা শিবের সঙ্গে যুক্ত হন
আজও ভক্তরা মন্দিরে গিয়ে নন্দীর কানে তাঁদের মনের কথা বলেন। কেউ চাকরি চায়, কেউ সন্তানের কামনা করে, কেউ সুখ-শান্তি চায়। সবাই নন্দীর কাছে আশা রাখে যে, তিনি তাঁদের কথা ভোলেনাথের কাছে পৌঁছে দেবেন। এই বিশ্বাসই একটি সাধারণ দেখতে মূর্তিকে ঈশ্বরের মাধ্যম বানিয়ে তোলে।