অষ্টাদশ শতাব্দীর স্কটল্যান্ড ছিল ইউরোপের বুদ্ধিবৃত্তিক, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক নবজাগরণের কেন্দ্র, যা আজ আমরা 'স্কটিশ আলোকিত যুগ' (Scottish Enlightenment) নামে জানি। এই সময়ে অনেক মহান বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও চিন্তাবিদ জন্মগ্রহণ করেন, যাঁরা শুধু ব্রিটেন নয়, সমগ্র বিশ্বে তাঁদের চিন্তা ও কর্মের গভীর ছাপ রেখেছেন। এই যুগের একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন ড. উইলিয়াম কুলেন। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, শিক্ষক এবং লেখক, যিনি চিকিৎসা ও বিজ্ঞানকে একটি সুসংবদ্ধ রূপ দিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। আসুন, উইলিয়াম কুলেনের জীবন, কর্ম এবং প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত জানি।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
উইলিয়াম কুলেন ১৫ই এপ্রিল, ১৭১০ সালে স্কটল্যান্ডের হ্যামিলটন নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা উইলিয়াম কুলেন ছিলেন ডিউক অফ হ্যামিলটনের অধীনে একজন ফ্যাক্টর (প্রबंधক), এবং তাঁর মাতা एलिजाবেথ রবার্টসন ছিলেন একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য। কুলেন হ্যামিলটনের ওল্ড গ্রামার স্কুলে শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং ১৭২৬ সালে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, যেখানে তিনি সাধারণ কলা (General Arts) অধ্যয়ন করেন।
কুলেন চিকিৎসাবিদ্যায় আগ্রহী হয়ে গ্লাসগোর একজন ঔষধালয় সার্জন জন প্যাসলের অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৭২৯ সালে তিনি একটি বণিক জাহাজে সার্জন হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভ্রমণ করেন। এর পরে তিনি লন্ডনে ফিরে আসেন, যেখানে তিনি কয়েক বছর একটি ফার্মেসিতে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। ১৭৩২ সালে স্কটল্যান্ডে ফিরে এসে তিনি শটস প্যারিশ এবং হ্যামিলটনে চিকিৎসা পরিষেবা শুরু করেন।
এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চিকিৎসা শিক্ষা
কুলেন ১৭৩৪ থেকে ১৭৩৬ সালের মধ্যে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিদ্যা বিষয়ে গভীর অধ্যয়ন করেন এবং রয়্যাল মেডিকেল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে একজন ছিলেন। এর পরে তিনি হ্যামিলটনে চিকিৎসা ব্যবসা শুরু করেন এবং শীঘ্রই একজন বিখ্যাত চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত হন।
১৭৪০ সালে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে এমডি ডিগ্রি প্রদান করে। ১৭৪৪ সালে ডিউক অফ হ্যামিলটনের মৃত্যুর পর তিনি গ্লাসগোতে চলে যান, যেখানে তিনি রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা এবং মেটেরিয়া মেডিকা (Materia Medica) বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়া শুরু করেন।
চিকিৎসা ও বিজ্ঞানে উদ্ভাবন
কুলেন তাঁর সুসংবদ্ধ শিক্ষণ শৈলী এবং গবেষণার জন্য ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্য পরিচিত। ১৭৪৭ সালে তিনি রসায়নবিদ্যায় ব্রিটেনের প্রথম স্বতন্ত্র প্রভাষক (Independent Lecturer) হন। তিনি শিক্ষামূলক পরিবেশে ছাত্রদের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করেন এবং চিকিৎসা শিক্ষাকে পরীক্ষামূলক করে তোলেন।
একটি উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হিসেবে তিনি ১৭৪৮ সালে আধুনিক হিমায়ন (Refrigeration)-এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি ডাইইথাইল ইথারকে আংশিক ভ্যাকুয়ামে ফুটিয়ে ঠান্ডা তৈরি করার প্রদর্শন করেন, যা থেকে বরফ তৈরি হয়েছিল। যদিও এর বাণিজ্যিক ব্যবহার তাৎক্ষণিক হয়নি, তবুও এটি আধুনিক শীতলীকরণ ব্যবস্থার দিকে প্রথম বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ ছিল।
এডিনবার্গে শিক্ষামূলক কাজ
১৭৫৫ সালে লর্ড কেমসের অনুরোধে কুলেন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন এবং মেডিসিনের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এখানে তিনি মেডিসিনের বিভিন্ন বিষয়ে, বিশেষ করে মেটেরিয়া মেডিকা এবং প্র্যাকটিস অফ ফিজিক (Practice of Physic)-এর উপর বক্তৃতা দেওয়া শুরু করেন। তিনি একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন এবং বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী তাঁর ক্লাসে যোগ দিত।
১৭৬৬ সালে তাঁকে 'প্র্যাকটিস অফ ফিজিক'-এর অধ্যাপক নিযুক্ত করা হয় এবং তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই পদে ছিলেন। তাঁর শিক্ষাদানের কাঠামো ছিল স্পষ্ট, সুসংগঠিত এবং ব্যবহারিক, যা ছাত্রদের বিষয় বুঝতে সাহায্য করত।
চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং নসোলজি
কুলেনের চিকিৎসাবিদ্যায় সবচেয়ে বড় অবদান ছিল তাঁর নসোলজি (রোগের শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতি)। তিনি রোগগুলোকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করেন, যা চিকিৎসা জ্ঞানকে সংগঠিত করতে সাহায্য করে। তিনি রোগগুলোকে চারটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করেন:
- কোমাটা: ঘুম এবং চেতনার অভাবজনিত রোগ।
- এডিনেমিয়া: শরীরের অনৈচ্ছিক গতি কমে যাওয়া।
- স্পাসমি: অনিয়মিত পেশী কার্যক্রম।
- ভেসানিয়া: মানসিক কার্যাবলীর ব্যাধি।
কুলেন বিশ্বাস করতেন যে অধিকাংশ রোগ স্নায়ুতন্ত্রের ভারসাম্যহীনতার কারণে হয়, এবং তিনি স্নায়ুতন্ত্রকে শরীরের "সজীব মেশিন" মনে করতেন। তিনি মনে করতেন যে সংবেদনশীলতা এবং বিরক্তি (irritability)-এর মধ্যে ভারসাম্যহীনতা রোগের মূল কারণ।
বিখ্যাত ছাত্র এবং বিশ্বব্যাপী প্রভাব
কুলেনের অনেক শিষ্য পরবর্তীতে বিশ্বখ্যাত চিকিৎসক, বিজ্ঞানী এবং শিক্ষক হন। তাঁদের মধ্যে বেঞ্জামিন রাশ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা), জোসেফ ব্ল্যাক (রসায়নবিদ), জন মর্গান (ফিলাডেলফিয়া মেডিকেল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা), স্যার গিলবার্ট ব্লেইন (রয়্যাল নেভি সংস্কারক) এবং জন ককলে লেটসসাম (লন্ডন মেডিকেল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা) প্রধান ছিলেন।
কুলেনের প্রভাব ইউরোপের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। ইতালি, জার্মানি এবং আমেরিকাতে তাঁর তত্ত্ব গৃহীত হয়। তাঁর একজন শিষ্য জন ব্রাউন তাঁর পদ্ধতির বিরোধিতা করে ব্রুনোনিয়ান পদ্ধতি তৈরি করেন, যা চিকিৎসা জগতে নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়।
সাহিত্যিক অবদান
কুলেন চিকিৎসা ও রসায়ন বিষয়ে অনেক বই লিখেছেন, যা ইউরোপ ও আমেরিকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। তাঁর প্রধান কাজগুলো ছিল:
- 'ফার্স্ট লাইন্স অফ দ্য প্র্যাকটিস অফ ফিজিক' (1777-1784): চিকিৎসা অনুশীলনের উপর তাঁর সুসংবদ্ধ পাঠ্যপুস্তক।
- 'সিনোপসিস নোসোলজিয়া মেথোডিকা' (1769): রোগ শ্রেণীবিন্যাসের মূল বই।
- 'ইনস্টিটিউশন্স অফ মেডিসিন' (1772): চিকিৎসা তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে রচিত গ্রন্থ।
- 'এ ট্রিটিজ অন মেটেরিয়া মেডিকা' (1789): ঔষধ এবং তাদের ব্যবহারিক প্রয়োগের উপর ভিত্তি করে রচিত গ্রন্থ।
চিকিৎসা পরিষেবা এবং পরামর্শ পদ্ধতি
কুলেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতায়ও পারদর্শী ছিলেন। তিনি তাঁর রোগীদের সঙ্গে চিঠির মাধ্যমে পরামর্শ করতেন। তাঁর সচিব দল সকাল সকাল আসা চিঠিগুলো পড়ে উত্তর তৈরি করত, যা কুলেন অনুমোদন করতেন। এই পদ্ধতি বিশেষভাবে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শিক্ষিত রোগীদের জন্য ছিল। এই প্রক্রিয়া তাঁকে পুরো ব্রিটেনে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। তিনি দিনের বাকি সময় এডিনবার্গে রোগীদের সঙ্গে সরাসরি দেখা করতেন।
ব্যক্তিগত জীবন এবং উত্তরাধিকার
কুলেন ১৭৪১ সালে অ্যানি জনস্টোনকে বিয়ে করেন এবং তাঁদের অনেক সন্তান ছিল। তাঁর পুত্র রবার্ট কুলেন স্কটল্যান্ডের বিশিষ্ট বিচারপতি হন এবং লর্ড কুলেনের উপাধি লাভ করেন। তাঁর আরেক পুত্র হেনরি কুলেনও বিখ্যাত চিকিৎসক হয়েছিলেন। কুলেন ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৭৯০ সালে এডিনবার্গে মারা যান। তাঁকে কিরকলিস্টনের গির্জার কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। তিনি একজন নিবেদিত শিক্ষক, বাস্তববাদী বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসা সেবার একজন সত্যিকারের সেবক হিসাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন।