স্যাম মানেকশ: ভারতীয় সেনাবাহিনীর 'স্যাম বাহাদুর'-এর বীরত্বপূর্ণ জীবন

স্যাম মানেকশ: ভারতীয় সেনাবাহিনীর 'স্যাম বাহাদুর'-এর বীরত্বপূর্ণ জীবন

ভারতীয় সেনার ইতিহাসে যদি কোনো নাম বীরত্ব, কৌশল এবং নেতৃত্বের নতুন মানদণ্ড স্থাপন করে থাকে, তবে তিনি হলেন ফিল্ড মার্শাল স্যাম হরমুসজি ফ্রেমজি জামশেদজি মানেকশ, যিনি দেশ এবং সেনাবাহিনীর কাছে 'স্যাম বাহাদুর' নামে পরিচিত। তাঁর জীবনযাত্রা, এক সাধারণ যুবক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদ – ফিল্ড মার্শাল পর্যন্ত, কেবল অনুপ্রেরণাদায়কই নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পথপ্রদর্শকও বটে।

প্রারম্ভিক জীবন থেকে অসাধারণ যাত্রা

স্যাম মানেকশর জন্ম ৩রা এপ্রিল ১৯১৪ সালে, পাঞ্জাবের অমৃতসরে, এক পার্সি পরিবারে। তাঁর পিতা ছিলেন ডাক্তার এবং তিনি অমৃতসরেই চিকিৎসা শুরু করেন। স্যামের প্রাথমিক শিক্ষা নৈনিতালের শেরউড কলেজে সম্পন্ন হয় এবং তিনি পরে ক্যামব্রিজ পরীক্ষায় অসাধারণ ফল করেন। যদিও তাঁর ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা ছিল, পরিস্থিতি তাঁকে ভারতীয় সামরিক একাডেমি, দেরাদুনে ভর্তি হতে প্ররোচিত করে। এখান থেকেই শুরু হয় এক যোদ্ধার কাহিনী, যিনি ১৯৭১ সালে ভারতকে একটি নতুন রাষ্ট্র – বাংলাদেশ – গঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বীরত্বের দৃষ্টান্ত

স্যাম মানেকশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বীরত্বের এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, যা দেখে শত্রুরাও তাঁর সাহসিকতার প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছিল। বার্মা অভিযানে যখন তাঁর কোম্পানির ওপর জাপানিরা আক্রমণ করে, তখন মানেকশ গুরুতরভাবে আহত হন। শরীরে সাতটি গুলি লাগে, কিন্তু তাঁর সাহস তাঁকে মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে আনে। এই বীরত্বের জন্য তিনি 'সামরিক ক্রস' সম্মানে ভূষিত হন। একজন আহত সৈনিকের মুখে হাসি এবং ঠোঁটে ব্যঙ্গ – এটাই ছিল তাঁর পরিচয়।

স্বাধীন ভারতের শক্তিশালী সেনাপতি

ভারতের স্বাধীনতার পর, স্যাম মানেকশকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পদে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়। ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হোক বা হায়দ্রাবাদ রাজ্যের যোগদান, তিনি প্রতিটি ফ্রন্টে তাঁর কৌশলগত দক্ষতার প্রমাণ দেন। তিনি কখনো পদাতিক ব্যাটেলিয়নের নেতৃত্ব দেননি, কিন্তু তাঁর তৈরি করা অপারেশন প্ল্যানগুলি আজও সামরিক অধ্যয়নের অংশ।

১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধ এবং মানেকশর প্রত্যাবর্তন

যদিও ভারত-চীন যুদ্ধে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ হয়নি, যুদ্ধের ব্যর্থতার পর যখন সরকারের একজন শক্তিশালী সামরিক নেতার প্রয়োজন হয়, তখন মানেকশকে আবার ডাকা হয়। তিনি উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিক্ষিপ্ত সেনাবাহিনীকে সংগঠিত করেন, মনোবল বাড়ান এবং সেনাবাহিনীর প্রস্তুতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান।

১৯৭১ সালের যুদ্ধ: নেতৃত্বের সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা

যখন ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)-এ রাজনৈতিক সংকট এবং গণহত্যা চরম আকার ধারণ করে, তখন ভারত হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যখন সেনাপ্রধান স্যাম মানেকশকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, 'যদি আমাকে আমার শর্তে কাজ করতে দেওয়া হয়, তবে আমি জয়ের গ্যারান্টি দিচ্ছি।'

মানেকশর এই স্পষ্টতা, দূরদৃষ্টি এবং প্রস্তুতির প্রতি অঙ্গীকারই ভারতীয় সেনাবাহিনীকে মাত্র ১৩ দিনের মধ্যে বিজয় এনে দেয়। এটি বিশ্বের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলির মধ্যে একটি ছিল, এবং পাকিস্তানের ৯৩,০০০ সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। এটিকে ভারতের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সামরিক সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ফিল্ড মার্শালের পদ – একটি ঐতিহাসিক সম্মান

স্যাম মানেকশকে ভারত সরকার ১৯৭৩ সালে 'ফিল্ড মার্শাল' উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে, যা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদ। এই সম্মান শুধুমাত্র তাঁদের দেওয়া হয় যাঁরা দেশের সুরক্ষায় অসাধারণ অবদান রেখেছেন। স্যাম মানেকশ ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি এই সম্মান লাভ করেন। তাঁর নেতৃত্ব ১৯৭১ সালের যুদ্ধে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যার কারণে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়। এই উপাধি আজীবন থাকে, অর্থাৎ এটি একটি আজীবন সম্মান। ভারতে এ পর্যন্ত মাত্র দু'জনকে এই পদ দেওয়া হয়েছে।

সেনাবাহিনীতে সমতা এবং অনুশাসনের পক্ষে

স্যাম মানেকশ কেবল একজন সাহসী সেনাপতিই ছিলেন না, বরং একজন নিরপেক্ষ এবং দূরদর্শী নেতাও ছিলেন। তিনি সবসময় সেনাবাহিনীতে সমতা এবং শৃঙ্খলাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। যখন সেনাবাহিনীতে জাতি বা ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণের কথা ওঠে, তখন তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, 'সেনাবাহিনীতে কেবল যোগ্যতাই গুরুত্বপূর্ণ, কোনো বিশেষ অধিকার থাকা উচিত নয়।' তাঁর ধারণা ছিল, দেশের সুরক্ষায় নিয়োজিত সৈন্যদের একতাবদ্ধ এবং নিঃস্বার্থ হতে হবে, কোনো জাতি বা ধর্মের সঙ্গে বাঁধা নয়। এই চিন্তাভাবনাই তাঁকে লক্ষ লক্ষ সৈন্যের কাছে একজন সত্যিকারের এবং নির্ভরযোগ্য নেতা করে তুলেছিল।

নম্রতা এবং হাস্যরসের উদাহরণ

স্যাম মানেকশ খুব সাহসী এবং বুদ্ধিমান সেনাপতি ছিলেন, কিন্তু তিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে খুবই হাস্যরসিক এবং সহজ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। যখন তিনি যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হন এবং ডাক্তার জিজ্ঞাসা করেন কি হয়েছে, তখন তিনি হেসে উত্তর দেন, 'একটি খচ্চর লাথি মেরেছিল।' এই কথা শুনে সবাই হাসতে শুরু করে। তাঁর মধ্যে সংকটকালে হাসিমুখে থাকার এবং অন্যদের মনোবল বাড়ানোর ক্ষমতা ছিল।

অন্তিমেও সৈন্যদের সঙ্গে

২৭শে জুন ২০০৮ সালে স্যাম মানেকশ যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, তখন তিনি কেবল একজন সৈনিক ছিলেন না, বরং ভারতের ইতিহাসের একটি গৌরবময় অধ্যায় হয়ে উঠেছিলেন। দুঃখের বিষয় হল, তাঁর মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী বা প্রতিরক্ষামন্ত্রী কেউই শ্রদ্ধা জানাননি। তবুও, তিনি কোটি কোটি দেশবাসীর হৃদয়ে "স্যাম বাহাদুর" হিসাবে আজও জীবিত আছেন।

স্যাম মানেকশ ছিলেন এমন একজন যোদ্ধা, যাঁর কৌশল ইতিহাস গড়েছে, যাঁর কথায় ছিল শক্তি, এবং যাঁর নেতৃত্বে শত্রুরা মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল। তিনি কেবল একজন সেনাপতি নন, বরং এক অনুপ্রেরণা – প্রত্যেক সেই যুবকের জন্য যে তার দেশের জন্য কিছু করতে চায়। স্যাম বাহাদুর আজও ভারতীয় সেনাবাহিনীর আদর্শ হয়ে আছেন এবং থাকবেন। 

Leave a comment