বিশ্ব শ্রবণ দিবস: শব্দ শোনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

বিশ্ব শ্রবণ দিবস: শব্দ শোনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

প্রতিদিন আমরা কথা বলি, শুনি এবং যোগাযোগ করি, কিন্তু আমরা কি সত্যিই 'শুনি'? ১৮ই জুলাই পালিত বিশ্ব শ্রবণ দিবস (World Listening Day) আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে শোনা কেবল মানুষের কথা নয়, বরং এই পৃথিবীর প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ফিসফিসানি, প্রতিটি পাখির কিচিরমিচির এবং প্রতিটি পাতার মর্মরও শোনা উচিত। এই দিনটি আমাদের শব্দ জগৎ এবং ধ্বনি পরিবেশের (soundscape) গুরুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

বিশ্ব শ্রবণ দিবসের উদ্দেশ্য

বিশ্ব শ্রবণ দিবস কেবল গোলমাল বন্ধ করা বা সাইলেন্ট মোডে যাওয়ার দিন নয়, বরং এই দিনটি ধ্বনি বাস্তুবিদ্যা (Acoustic Ecology) এর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার একটি প্রচেষ্টা। এর উদ্দেশ্য হল মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যেকার ধ্বনি সম্পর্কিত বোঝাপড়াকে উন্নত করা এবং আমাদের চারপাশের আওয়াজগুলো আমরা কীভাবে গ্রহণ করি সে সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া।

ইতিহাস: কেন ১৮ই জুলাই তারিখটি বেছে নেওয়া হয়েছিল?

আর. মারে শ্যাফার অনুভব করেছিলেন যে আমাদের পৃথিবী কেবল দেখা এবং বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, শোনারও সমান গুরুত্ব রয়েছে। তিনি শব্দের মাধ্যমে পরিবেশকে বোঝার নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন এবং 'ওয়ার্ল্ড সাউন্ডস্কেপ প্রজেক্ট'-এর মাধ্যমে শব্দ দূষণ কমানোর উপর জোর দিয়েছিলেন। ১৮ই জুলাই তাঁর জন্মদিন, এবং এই কারণে এই দিনটিকে 'ওয়ার্ল্ড লিসেনিং ডে' হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমাদের প্রকৃতি ও সমাজের আওয়াজ মনোযোগ দিয়ে শোনা উচিত, যাতে আমরা আমাদের চারপাশে ঘটা পরিবর্তনগুলি আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি।

শব্দ শোনা কেন জরুরি?

আজকালকার ব্যস্ত জীবনে আমরা কেবল প্রয়োজনীয় আওয়াজগুলোই শুনি – ফোনের রিং, গাড়ির হর্ন, বা টিভির আওয়াজ। কিন্তু আমরা এটা ভুলে যাই যে প্রকৃতিও আমাদের সঙ্গে কথা বলে, শুধু আমাদের মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে।
পাখিদের গান, পাতার মর্মর, বাতাসের শনশন – এই সকল ধ্বনি আমাদের মানসিক শান্তি দিতে সাহায্য করে। এই শোনা কেবল মনকে শান্তি দেয় না, বরং আমাদের পরিবেশের স্বাস্থ্যকেও বুঝতে সাহায্য করে।

কীভাবে বিশ্ব শ্রবণ দিবস পালন করবেন?

১. আপনার আশেপাশের শব্দগুলো শুনুন

এই দিনে একটু সময় বের করে আপনার আশেপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশকে মনোযোগ দিয়ে শুনুন। মোবাইল ফোন সাইলেন্ট করুন, কোনো পার্কে যান, বা বারান্দায় বসে চোখ বন্ধ করুন। আপনি দেখবেন যে কত আওয়াজ আছে যা আপনি আগে কখনও মনোযোগ দিয়ে শোনেননি।

২. লিসেনিং পার্টির আয়োজন করুন

আপনার স্কুল, অফিস বা কমিউনিটিতে একটি লিসেনিং পার্টির আয়োজন করুন। এতে লোকেরা কিছুক্ষণের জন্য চুপচাপ বসে কোনো প্রাকৃতিক ধ্বনির রেকর্ডিং শুনতে পারে – যেমন বৃষ্টির ফোঁটা, সমুদ্রের ঢেউ বা জঙ্গলের আওয়াজ। এর পরে অভিজ্ঞতা বিনিময় করুন এবং শোনার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করুন।

৩. শব্দ দূষণ কমান

আপনি ছোট ছোট পদক্ষেপের মাধ্যমে নয়েজ পলিউশন কমাতে সাহায্য করতে পারেন। যেমন:

  • অপ্রয়োজনে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বন্ধ রাখুন
  • বাইক বা গাড়ির বদলে সাইকেল চালান
  • লাউডস্পিকারের সীমিত ব্যবহার করুন
  • ওয়াশিং মেশিন বা মিক্সারের মতো মেশিন দরজা বন্ধ করে চালান
  • গাছ লাগান, কারণ গাছ শব্দ শোষণ করতে সাহায্য করে

সামষ্টিক প্রচেষ্টা জরুরি

শহর এবং শহরতলিতে ক্রমবর্ধমান শব্দ আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর খারাপ প্রভাব ফেলে। তাই 'বিশ্ব শ্রবণ দিবস'-এর প্রাক্কালে এটা জরুরি যে আমরা কেবল নিজেরাই শান্ত পরিবেশ তৈরি করি না, বরং সমাজকেও শব্দ দূষণ থেকে বাঁচাতে পদক্ষেপ নিই। শহরের পরিকল্পনা করার সময় শান্ত অঞ্চলগুলোকে উৎসাহিত করা, পথচারীদের জন্য বিশেষ রাস্তা তৈরি করা এবং শব্দ নিরোধক দেয়াল তৈরি করার মতো পরিকল্পনা শব্দ ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে। এই ছোট ছোট পরিবর্তন পুরো সম্প্রদায়ের জন্য একটি বড় পার্থক্য আনতে পারে।

মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য শোনাও জরুরি

যখন আমরা প্রতিদিনের ব্যস্ততায় জড়িয়ে থাকি, তখন আমাদের মন প্রায়শই ক্লান্ত হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে যদি আমরা কিছু সময় বের করে প্রকৃতির আওয়াজ শুনি, যেমন গাছের পাতার মর্মর, পাখির কিচিরমিচির বা বহমান জলের শব্দ, তাহলে আমাদের চাপ ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। এই প্রাকৃতিক শব্দগুলো শোনা শুধু মনকে শান্ত করে না, আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকেও মজবুত করে। এতে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার ক্ষমতা বাড়ে এবং আমরা নিজেকে আরও বেশি ভারসাম্যপূর্ণ মনে করি। তাই 'শোনাও' এক ধরনের ধ্যান কৌশল।

ধ্বনি পরিবেশ এবং প্রযুক্তি

আজকাল মোবাইল, ইয়ারফোন এবং স্ক্রিন আমাদের এতটাই ঘিরে রেখেছে যে আমরা আশেপাশের প্রাকৃতিক ধ্বনি শুনতেই পাই না। আমরা গান, ভিডিও এবং কলে এতটাই মগ্ন থাকি যে পাখির কিচিরমিচির, বাতাসের শনশন বা বাচ্চাদের হাসি-এর মতো জীবন্ত অভিজ্ঞতা থেকে দূরে চলে যাই। বিশ্ব শ্রবণ দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে প্রযুক্তির সঙ্গে বসবাস করেও আমাদের নিজের ধ্বনি পরিবেশের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখা উচিত। মাঝে মাঝে ইয়ারফোন খুলে রেখে শুধু এমনিই বসা, এবং মনোযোগ দিয়ে আশেপাশের আওয়াজ শোনাও একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা হতে পারে।

বিশ্ব শ্রবণ দিবস আমাদের বোঝায় যে শুধু শোনা নয়, মনোযোগ দিয়ে এবং মন দিয়ে শোনাও জরুরি। যখন আমরা আমাদের চারপাশের শব্দগুলোকে সত্যি করে অনুভব করি, তখন আমরা প্রকৃতি, সমাজ এবং নিজের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হতে পারি। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে শান্ত পরিবেশ এবং সংবেদনশীল শোনার অভ্যাস আমাদের মানসিক এবং আবেগিক স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি। আসুন, আমরা সবাই মিলে শোনার এই শিল্পকে গ্রহণ করি এবং অন্যদেরকেও সচেতন করি।

Leave a comment