অ্যাপেনডিক্স—একটা ছোট্ট অঙ্গ, বড় বিপদ
মানুষের বৃহদান্তের সঙ্গে জুড়ে থাকা ছোট্ট থলির মতো অঙ্গ হলো অ্যাপেনডিক্স। আকারে ছোট হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে পারে প্রাণঘাতী বিপদ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চিকিৎসকরা লক্ষ্য করেছেন—ভয়ঙ্কর হারে বাড়ছে অ্যাপেনডিক্স ক্যানসারের ঘটনা। যখন অ্যাপেনডিক্সে অস্বাভাবিক হারে কোষ বাড়তে শুরু করে, তখন সেখানে টিউমর তৈরি হয়। এই টিউমর কখনও নিরীহ (benign) হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা ম্যালিগন্যান্টে পরিণত হয়ে শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
দুর্ভাগ্যের নাম দেরিতে ধরা পড়া
StatPearls–এর এক সমীক্ষা বলছে, অ্যাপেনডিক্স ক্যানসারের মূল ভয়াবহতা হলো দেরিতে শনাক্ত হওয়া। রোগীরা অনেক সময় বুঝতেই পারেন না—এটি পেটের সাধারণ ব্যথা নাকি ক্যানসারের শুরু! উপসর্গগুলো সাধারণ গ্যাস্ট্রিক সমস্যা বা বদহজমের মতো হওয়ায় সহজেই বিভ্রান্তি তৈরি হয়। আর এই একটি ভুলের জন্যই যখন ধরা পড়ে, তখন অনেক সময় রোগ হাতের বাইরে চলে যায়।
পেট ফুলে যাওয়া বা অস্বাভাবিক ফেঁপে থাকা
এই রোগের অন্যতম সাধারণ লক্ষণ হলো পেট হঠাৎ ফুলে যাওয়া বা অস্বাভাবিক ফেঁপে ওঠা। সাধারণ গ্যাসের সমস্যা ভেবে অনেকেই অবহেলা করেন, অথচ এটি অ্যাপেনডিক্স ক্যানসারের প্রাথমিক সংকেত হতে পারে।
পেটে তরল জমা—অস্বস্তির মূল কারণ
অ্যাপেনডিক্স ক্যানসার হলে অনেক ক্ষেত্রে পেটে জল জমে যায়। ধীরে ধীরে পেট ভারী হতে শুরু করে, দৈনন্দিন চলাফেরায় আসে অস্বস্তি। এ ধরনের উপসর্গ উপেক্ষা না করে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া জরুরি।
কোমরের মাপ বাড়ে, কিন্তু ওজন একই থাকে
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এক অদ্ভুত লক্ষণ হলো কোমরের মাপ বেড়ে যাওয়া। অথচ শরীরের ওজন তেমন না বাড়লেও পেটের মাপ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতে পারে। এটি অ্যাপেনডিক্স ক্যানসারের দিকে ইঙ্গিত করতে পারে।
লাগাতার ব্যথার সংকেত
পেটে বা পেলভিক অঞ্চলে বারবার বা দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা এই রোগের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। সাধারণ গ্যাস্ট্রিক সমস্যা বা মাসিকজনিত ব্যথা ভেবে এড়িয়ে গেলে বড় ক্ষতি হতে পারে।
বমি, বদহজম ও অস্বাভাবিক তৃপ্তি
বারবার বমি বা বমিভাব, মলত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন এবং সামান্য খাবার খেলেও পেট ভরে যাওয়ার অনুভূতি—এসব উপসর্গ অনেক সময় অ্যাপেনডিক্স ক্যানসারের জানান দেয়।
সিউডোমিক্সোমা—বিশেষ জটিল অবস্থা
কিছু ক্ষেত্রে অ্যাপেনডিক্স ক্যানসার থেকে তৈরি হয় সিউডোমিক্সোমা। এতে পেটে জেলির মতো তরল জমা হয়, যার ফলে পেট ফুলে গিয়ে শ্বাসকষ্ট ও অস্বস্তি বাড়ে। এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানে জটিল এবং ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি হিসেবে ধরা হয়।
কারা বেশি ঝুঁকিতে?
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সিদের মধ্যে এই রোগের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। মহিলারা পুরুষদের তুলনায় বেশি আক্রান্ত হন। ধূমপান, অ্যাটরোফিক গ্যাসট্রাইটিস ও পারনিশিয়াস অ্যানিমিয়ায় ভোগা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও অ্যাপেনডিক্স ক্যানসারের ঝুঁকি প্রবল।
প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লেই বাঁচার সুযোগ
ক্যানসারের নাম শুনলেই ভয় ধরায়। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রোগকে হারানোর মূল চাবিকাঠি হলো সময়মতো শনাক্ত করা। যত দ্রুত ক্যানসারের উপসর্গ ধরা পড়ে, চিকিৎসা ততটাই সফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দেরি হলেই পরিস্থিতি মারণ হয়ে ওঠে।
ক্যানসারের ভয়ঙ্কর বিস্তার
মেডিক্যাল জার্নাল ‘দ্য ল্যানসেট’-এর রিপোর্ট বলছে, ভারতে ক্যানসার ধীরে ধীরে মহামারির আকার নিচ্ছে। ২০২২ সালের পর থেকে সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে—প্রতি ১ লক্ষ মানুষের মধ্যে যেখানে আগে ক্যানসারে মৃত্যুর হার ছিল ৬৪.৭, তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০৯.৬ জনে।
ভারতে তৃতীয় স্থানে ক্যানসারের প্রকোপ
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (ICMR)-এর সমীক্ষা জানাচ্ছে, ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যায় ভারত বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় স্থানে। প্রতি পাঁচজন ক্যানসার রোগীর মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হচ্ছে, যা ভয়ঙ্কর পরিসংখ্যান। অ্যাপেনডিক্স ক্যানসারও এই ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর হারে বড় ভূমিকা রাখছে।
সতর্ক থাকাই প্রতিরোধের প্রথম ধাপ
অ্যাপেনডিক্স ক্যানসার সাধারণ পেটের রোগ ভেবে ভুল করলে সর্বনাশ অবধারিত। তাই উপসর্গগুলোকে অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার। সময়মতো পরীক্ষা ও চিকিৎসাই এই মারণ রোগ থেকে রক্ষা পেতে পারে প্রাণ।