মানব সভ্যতার অন্যতম বৃহৎ এবং প্রভাবশালী আবিষ্কারগুলির মধ্যে একটি হল বিমান বা এয়ারপ্লেন। এটি এমন একটি প্রযুক্তি যা কেবল ভ্রমণের পদ্ধতিকেই পরিবর্তন করেনি, বরং বিশ্বকে ছোট করে এনেছে। আজ আমরা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যেতে পারি, এবং এর কৃতিত্ব সেই মহান আবিষ্কারের, যা আমরা 'এয়ারপ্লেন' হিসাবে জানি। কিন্তু আপনি কি কখনও ভেবেছেন, এই এয়ারপ্লেন কবে তৈরি হয়েছিল, কে তৈরি করেছিল, এবং কীভাবে একটি ভারী যন্ত্র আকাশে উড়তে শুরু করল?
এয়ারপ্লেন তৈরির কল্পনা: শুরুটা কোথা থেকে?
আকাশে ওড়ার কল্পনা মানুষ হাজার বছর আগে থেকেই করেছে। পৌরাণিক কাহিনী, গল্প এবং ছবিতে উড়ন্ত পাখিদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল যে একদিন সেও আকাশের উচ্চতা ছুঁতে পারবে।
ভারতে আমরা ' pushপুষ্পক বিমান'-এর মতো উদাহরণ প্রাচীন গ্রন্থে পাঠ করি। কিন্তু বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে দেখলে, ১৫ শতকের মহান শিল্পী এবং বিজ্ঞানী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি সর্বপ্রথম 'উড়ন্ত যন্ত্র' এর ডিজাইন তৈরি করেছিলেন। যদিও এই ডিজাইনগুলি ছিল তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিকভাবে সফল হয়নি।
এয়ারপ্লেনের আবিষ্কারক কে?
প্রথম সফলভাবে উড়ন্ত বিমানের কৃতিত্ব রাইট ভাইদের — অর্বিল রাইট এবং উইলবার রাইটের। এই দুই ভাই আমেরিকার বাসিন্দা ছিলেন, যারা শুরুতে সাইকেল মিস্ত্রি ছিলেন, কিন্তু তাদের আগ্রহ ছিল উড্ডয়ন প্রযুক্তির প্রতি।
তারা বহু বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, ডিজাইন পরিবর্তন করেছেন, ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন, কিন্তু অবশেষে ১৭ ডিসেম্বর ১৯০৩ সালে আমেরিকার কিত্তি হক, নর্থ ক্যারোলিনাতে বিশ্বের প্রথম সফল বিমান উড্ডয়ন করেন।
তাদের উড়োজাহাজের নাম ছিল 'ফ্লায়ার-১' (Flyer-1)।
কীভাবে তৈরি হয়েছিল প্রথম এয়ারপ্লেন?
রাইট ভাইদের এয়ারপ্লেন কোনো বিলাসবহুল বিমান ছিল না। এটি ছিল হালকা কাঠের কাঠামো, যার উপর কাপড়ের আস্তরণ ছিল এবং একটি ছোট ইঞ্জিন লাগানো ছিল। এর দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১২ মিটার এবং ওজন ছিল মাত্র ২৭৪ কিলোগ্রাম।
এই বিমানটিকে আকাশে ওড়ানোর জন্য চারটি প্রধান জিনিস ব্যবহার করা হয়েছিল:
- উইং (ডানা) – আকাশে ওড়ার জন্য প্রধান কাঠামো।
- প্রপেলার (ঘূর্ণায়মান পাখা) – যা ইঞ্জিনের শক্তি দ্বারা ঘোরে এবং সামনের দিকে ধাক্কা দেয়।
- রডার এবং এলিভেটর – যা দিক পরিবর্তন এবং উচ্চতা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করত।
- ইঞ্জিন – একটি ছোট কিন্তু হালকা পেট্রোল ইঞ্জিন যা প্রপেলার ঘোরাতো।
রাইট ভাইয়েরা এটিকে প্রথমে একটি গ্লাইডারের মতো উড়িয়েছিলেন এবং তারপর ইঞ্জিন যোগ করে এটিকে একটি সম্পূর্ণ এয়ারপ্লেন তৈরি করেন।
প্রথম উড্ডয়ন কেমন ছিল?
১৭ ডিসেম্বর ১৯০৩ সকাল ১০:৩৫ মিনিটে, অর্বিল রাইট ইতিহাস তৈরি করেন। তিনি "ফ্লায়ার-১" নামক বিমান থেকে প্রথমবার আকাশে ওড়েন। এই উড্ডয়নটি মাত্র ১২ সেকেন্ড স্থায়ী হয়েছিল এবং প্রায় ১২০ ফুট দূরত্ব অতিক্রম করেছিল, কিন্তু এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এটিই প্রথমবার যখন কোনো মানুষ ইঞ্জিন চালিত যন্ত্রের সাহায্যে আকাশে উড়তে পারল, তাও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিতভাবে। এই ক্ষুদ্র উড্ডয়ন ভবিষ্যতের বিমান ভ্রমণের ভিত্তি স্থাপন করে এবং মানুষের স্বপ্নকে আকাশে পৌঁছে দেয়।
এয়ারপ্লেন কীভাবে ওড়ে?
এয়ারপ্লেন ওড়ার পেছনে চারটি প্রধান নীতি রয়েছে, যা 'ফ্লাইটের চারটি বল' নামে পরিচিত:
- লিফ্ট (Lift) – ডানার উপর বাতাসের চাপ যা বিমানকে উপরে তোলে।
- থ্রাস্ট (Thrust) – ইঞ্জিন দ্বারা সামনের দিকে প্রযুক্ত বল।
- ড্র্যাগ (Drag) – বাতাসের বাধা, যা বিমানকে পিছন দিকে টানে।
- ওয়েট (Weight) – মাধ্যাকর্ষণ শক্তি যা নিচে টানে।
যখন লিফট, ওয়েট-এর চেয়ে বেশি হয় এবং থ্রাস্ট, ড্র্যাগ-এর চেয়ে বেশি হয় — তখন বিমান ওড়ে।
এয়ারপ্লেনের বিকাশ এবং আধুনিক যুগ
রাইট ভাইদের প্রথম উড্ডয়নের পর, অনেক বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী এবং দেশ এই প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করেছে।
- প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪–১৯১৮)-এ বিমানের ব্যবহার যুদ্ধের জন্য করা হয়েছিল।
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯–১৯৪৫) পর্যন্ত বিমানগুলি রকেটের মতো দেখতে হয়ে গিয়েছিল।
- ১৯৬৯ সালে প্রথম সুপারসনিক বিমান কনকর্ড তৈরি হয়েছিল, যা শব্দের গতিতে উড়ত।
আজ এয়ারপ্লেন কেবল যাত্রী পরিবহনের জন্য এক দেশ থেকে অন্য দেশে যায় না, এছাড়াও:
- সামরিক কাজে,
- কার্গো এবং মাল পরিবহনে,
- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা,
- আবহাওয়ার পূর্বাভাস,
- এবং মহাকাশ গবেষণায়ও ব্যবহৃত হচ্ছে।
ভারত এবং বিমান চলাচল ক্ষেত্র
ভারতে বিমান চলাচল ক্ষেত্রের সূচনা হয় ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯১১ সালে, যখন এলাহাবাদ থেকে নৈনির মধ্যে প্রথম বাণিজ্যিক উড্ডয়ন হয়। এরপর থেকে ভারত এই ক্ষেত্রে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছে। আজ, এয়ার ইন্ডিয়া, ইন্ডিগো, স্পাইসজেট, विस्तারা-এর মতো প্রধান এয়ারলাইন্সগুলি প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ যাত্রীকে একটি শহর থেকে অন্য শহরে নিরাপদে পৌঁছে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, ভারত তার নিজস্ব যুদ্ধবিমান "তেজস"ও তৈরি করেছে, যা এখন দেশের সুরক্ষার জন্য আকাশের উচ্চতায় দৃঢ়ভাবে উড়ছে।
এয়ারপ্লেনের আবিষ্কার মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বিপ্লবী অর্জনগুলির মধ্যে একটি। রাইট ভাইদের দূরদৃষ্টি, পরীক্ষা-নিরীক্ষার মানসিকতা এবং সংকল্প আকাশে ওড়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে। আজ, বিমান শুধু ভ্রমণের একটি মাধ্যম নয়, এটি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং মানব সংকল্পের উড়ানের প্রতীকও। এটি আমাদের শেখায় যে কোনো স্বপ্নই অসম্ভব নয়।