বিশ্ব আন্তর্জাতিক ন্যায় বিচার দিবস প্রতি বছর ১৭ই জুলাই তারিখে পালিত হয়। এই দিবসটি ন্যায়বিচার, দায়বদ্ধতা এবং মানবাধিকারের সার্বজনীন চেতনার উদযাপন হিসেবে বিবেচিত হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য হল আন্তর্জাতিক স্তরে বিচার ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, যুদ্ধ-নির্যাতিত এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার প্রদান করা, এবং বিশ্বে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও দায়বদ্ধতাকে উৎসাহিত করা।
আজকের দিনে যখন মানবাধিকার লঙ্ঘন, যুদ্ধাপরাধ এবং অত্যাচারের মতো ঘটনাগুলি বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন এই দিবসটি বিশ্ব সম্প্রদায়কে স্মরণ করিয়ে দেয় যে অপরাধী যেই হোক না কেন, তাকে শাস্তি পেতেই হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তকে ন্যায়বিচার দিতে হবে।
বিশ্ব আন্তর্জাতিক ন্যায় বিচার দিবসের উদ্দেশ্য
- আন্তর্জাতিক অপরাধের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
- যুদ্ধ-নির্যাতিত, বাস্তুচ্যুত এবং অবিচার সহ্য করা মানুষদের ন্যায়বিচার প্রদান করা।
- মানবাধিকার রক্ষা করা এবং বিচার বিভাগীয় সংস্থাগুলির ভূমিকা শক্তিশালী করা।
- অপরাধীদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে উৎসাহিত করা।
বিশ্ব আন্তর্জাতিক ন্যায় বিচার দিবসের ইতিহাস
এই দিবসের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে ১৯৯৮ সালে ইতালির রোমে অনুষ্ঠিত হওয়া সেই ঐতিহাসিক সম্মেলনের সঙ্গে, যেখানে "রোম সংবিধি (Rome Statute)" গৃহীত হয়েছিল। এই সংবিধির অধীনেই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC - International Criminal Court) প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। এই রোম সংবিধি ১লা জুলাই ২০০২ সাল থেকে কার্যকর হয় এবং সেই দিন থেকেই ICC কাজ শুরু করে।
২০১০ সালে উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় অনুষ্ঠিত একটি পর্যালোচনা সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে প্রতি বছর ১৭ই জুলাই বিশ্ব আন্তর্জাতিক ন্যায় বিচার দিবস হিসেবে পালন করা হবে। এর মূল লক্ষ্য হল রোম সংবিধির গুরুত্ব এবং আন্তর্জাতিক অপরাধের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের প্রয়োজনীয়তাকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) এর পরিচয়
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) হল বিশ্বের প্রথম স্থায়ী, স্বাধীন এবং আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল, যা গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ICC-এর সদর দপ্তর নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত।
জুলাই ২০০২ সাল থেকে ICC আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করেছে।
ICC-এর আওতাভুক্ত প্রধান অপরাধসমূহ
- গণহত্যা (Genocide)
- যুদ্ধাপরাধ (War Crimes)
- মানবতাবিরোধী অপরাধ (Crimes Against Humanity)
- আগ্রাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত অপরাধ (Crime of Aggression)
ICC-এর উদ্দেশ্য হল সেইসব অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া, যা কোনো একটি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত হয় এবং যেগুলির উপর সেই দেশের বিচার ব্যবস্থা কার্যকর ব্যবস্থা নিতে অক্ষম হয়।
ভারত এবং ICC-এর অবস্থান
ভারত এখন পর্যন্ত রোম সংবিধিতে স্বাক্ষর করেনি এবং সেই কারণে এটি ICC-এর সদস্য নয়। ভারতের ICC থেকে দূরে থাকার পিছনে কিছু সুস্পষ্ট কারণ রয়েছে:
- ভারতের যুক্তি ও আপত্তি: জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি: ভারত মনে করে যে ICC-এর কিছু ধারা তার অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব, সামরিক নীতি এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বাধা হতে পারে।
- জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রভাব: ভারতের আশঙ্কা, ICC-এর উপর নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের (যাদের ভেটো ক্ষমতা আছে) অতিরিক্ত প্রভাব থাকে। এর ফলে বিচার বিভাগীয় নিরপেক্ষতা প্রভাবিত হতে পারে।
- কাশ্মীর এবং মাওবাদী অধ্যুষিত অঞ্চলে প্রভাব: ভারতের আশঙ্কা, তার অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলি (যেমন কাশ্মীর বা মাওবাদী অধ্যুষিত অঞ্চল) -তে ICC-এর হস্তক্ষেপ তার নীতি ও কার্যকলাপে বাধা দিতে পারে।
যদিও ভারত মানবাধিকারের প্রতি তার অঙ্গীকারের বিষয়ে স্পষ্ট এবং অভ্যন্তরীণ আইনগুলির অধীনেই যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো ধারায় কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেছে।
ICC এবং বিশ্বব্যাপী প্রভাব
বর্তমানে ICC-এর সদস্য দেশের সংখ্যা ১২০টিরও বেশি। অনেক দেশে ICC-এর প্রচেষ্টার কারণে যুদ্ধাপরাধী এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। আফ্রিকা, ইউরোপ এবং ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশে ICC ন্যায়বিচার প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যদিও আমেরিকা, চীন, রাশিয়া-র মতো বড় দেশগুলিও ICC-এর পূর্ণ সদস্য নয়। আমেরিকা স্বাক্ষর করলেও পরে তা প্রত্যাহার করে নেয়।
আজকের বিশ্ব প্রেক্ষাপটে যখন বিশ্বের বিভিন্ন অংশে যুদ্ধ, জাতিগত সহিংসতা, গণহত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, তখন ICC-এর প্রাসঙ্গিকতা এবং এই দিবসের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে। এই দিবসটি বিশ্বনেতা এবং সংস্থাগুলিকে মনে করিয়ে দেয় যে ন্যায়বিচার ছাড়া শান্তি অসম্ভব।