ডিএ মামলায় রাজ্যকে কড়া বার্তা সুপ্রিম কোর্টের নিজের তৈরি নিয়ম নিজেকেই মানতে হবে!

ডিএ মামলায় রাজ্যকে কড়া বার্তা সুপ্রিম কোর্টের নিজের তৈরি নিয়ম নিজেকেই মানতে হবে!

সপ্তাহ ঘুরতেই ফের ডিএ মামলা সুপ্রিম কোর্টে, তুঙ্গে উত্তেজনা

বৃহস্পতিবার ফের আলোচনার কেন্দ্রে ডিএ মামলা। সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি সঞ্জয় করোল এবং বিচারপতি পিকে মিশ্রের বেঞ্চে চলল শুনানি। আগের দিন সরকারি কর্মীদের পক্ষের সওয়াল শোনার পর এদিন রাজ্যের তরফে আইনজীবী শ্যাম দিওয়ান জানালেন তাঁদের যুক্তি। আবার আলোচনায় উঠে এল রাজ্যের সংবিধানিক অধিকার, চাকরির শর্ত এবং রোপা রুলস সংক্রান্ত নানা জটিল দিক। আদালতে হাজির দুই পক্ষের সওয়াল-জবাবকে ঘিরে courtroom জমজমাট হয়ে উঠেছিল।

ডিএ না দেওয়ার সিদ্ধান্তে মহাজনসুলভ মনোভাব? কটাক্ষ বিচারপতিদের

২০০৬-২০০৮ এবং ২০১৯-২০২১—দুই সময়পর্বে মহার্ঘ ভাতা না দেওয়ার অভিযোগের প্রসঙ্গ ফের টেনে আনেন বিচারপতিরা। তীব্র কটাক্ষ করে তাঁরা বলেন, “পুরনো দিনের মহাজনের মতো রাজ্য সরকার টাকা জমিয়ে রেখে অন্যত্র বিনিয়োগ করেছে!” এই পর্যবেক্ষণ শুধু প্রহসন নয়, বরং সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে আর্থিক অনীহার প্রকাশ বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আদালতের এমন তুলনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে কর্মচারী সংগঠন।

‘নিজের তৈরি রুল মানতেই হবে!’—রাজ্যের মুখোমুখি আদালত

শ্যাম দিওয়ান আদালতে জানান, মহার্ঘ ভাতা দেওয়া বা না দেওয়ার অধিকার সম্পূর্ণভাবে রাজ্যের। এটি একটি সাংবিধানিক প্রশ্ন, আর রাজ্য নিজস্ব শর্তে নিয়োগ করে সরকারি কর্মী। তবে বিচারপতি পিকে মিশ্র কড়া ভাষায় পাল্টা বলেন, “আপনারাই বলেছিলেন রোপা অনুযায়ী ডিএ দেবেন। আপনি নিজেই বলেছিলেন বকেয়া ডিএ মেটানো হবে। তাহলে রুল মানতে বাধ্য আপনিই!” এই পর্যবেক্ষণে কার্যত রাজ্যের যুক্তিকে নস্যাৎ করে দেয় শীর্ষ আদালত।

‘যার যেমন খুশি ডিএ!’—খোঁচা সরকারি কর্মীদের আইনজীবীর

সরকারের খেয়ালখুশিমতো ডিএ দেওয়া হচ্ছে—এই অভিযোগ তুলে সরকারি কর্মীদের আইনজীবী রউফ রহিম বলেন, “একটা নির্দিষ্ট নীতি নেই। এই অস্পষ্টতা কাজে লাগিয়ে রাজ্য বিভ্রান্তি তৈরি করছে।” তাঁর অভিযোগ, সরকার ইচ্ছেমতো আর্থিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, অথচ তাতে কর্মীদের বেতন-ডিএ নির্ভরতা থেকে যাচ্ছে। বিচারপতিরা একমত হন যে আর্থিক ইমার্জেন্সি না থাকলেও সরকার সমস্যাকে কাজে লাগাচ্ছে।

মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে ডিএ জরুরি, তবু রাজ্য উদাসীন!

১০ হাজার টাকার ডিএ এক কর্মীর জন্য যথেষ্ট নয়, যখন জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া, বলেন রউফ রহিম। তিনি জানান, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মেলাতেই ডিএ বাড়ানোর প্রয়োজন। কিন্তু রাজ্য সরকার তার দায়িত্ব মানতে নারাজ। বেতন কমিশনের সুপারিশও মানছে না তারা। কোন ভিত্তিতে ডিএ দেওয়া হচ্ছে, তার কোনও সদুত্তর নেই বলেই দাবি করা হয় কর্মচারী সংগঠনের তরফে।

'২০০৬ থেকে ২০০৮'-এর বকেয়া ডিএ দেওয়া হয়নি, রোপা লঙ্ঘন?

রাজ্য আইনজীবীর দাবি অনুযায়ী, ২০০৯ সালের রোপা রুল অনুযায়ী ডিএ হিসাবের ভিত্তি ঠিক হয়েছিল AICPI। কিন্তু ২০০৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০০৮ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময়ের ডিএ arrear দেওয়া হয়নি। এই তথ্য আদালতে পেশ করে প্রশ্ন ওঠে—সরকার কি ইচ্ছাকৃতভাবে এই বকেয়া পরিশোধ করেনি? যদি নিয়ম বলেই ডিএ হিসাব করা হয়, তবে এই সময়কালের ডিএ না দেওয়া কেন?

‘এক আইন, দুই রকম ডিএ!’—সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ

গোপাল সুব্রহ্মণ্যম জানান, রোপা রুলস ২০০৯ সব সরকারি কর্মীর ওপর সমভাবে প্রযোজ্য। অথচ দিল্লি বা চেন্নাইয়ের রাজ্য কর্মচারীরা কেন্দ্রীয় হারে ডিএ পেলেও পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী কর্মচারীরা তা পাচ্ছেন না। কেন্দ্রীয় পদ্ধতিতে কষা AICPI ইনডেক্স ব্যবহার করা হলেও, রাজ্যে বসবাসকারী কর্মীদের জন্য তা মানা হচ্ছে না। ফলে, একই কর্মপরিসরে থাকা কর্মীদের মধ্যেই বৈষম্য তৈরি হচ্ছে।

‘সমতার অধিকার ভঙ্গ’, আর্টিকেল ১৪-এ প্রশ্নচিহ্ন

বিচারপতির প্রশ্নের উত্তরে গোপাল দাবি করেন, একই নীতির ভিত্তিতে ডিএ না দেওয়াটা সংবিধানের Article 14 অনুযায়ী বৈষম্যমূলক। কারণ আইন সবার জন্য সমান। কেউ বেশি, কেউ কম—এভাবে ডিএ নির্ধারণ করা যায় না। এতে সরকার নিজের সুবিধামতো পরিস্থিতি তৈরি করছে। আদালত মনে করে, এটি সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘনের সামিল হতে পারে।

‘AICPI অনুসারে হিসাব না হলে, নিরপেক্ষতা কোথায়?’

বিচারপতি পি কে মিশ্র জানতে চান, কেন AICPI ইনডেক্সের অ্যাভারেজ মান (৫৩৬) ডিএ নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়নি? পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে কোনও নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা না আসায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। বিজেপি কর্মচারী সংগঠনের আইনজীবী পি এস পাটোয়ালির সওয়াল দিয়ে পরবর্তী পর্যায়ে গড়ায় মামলার শুনানি।

মামলার রায় এখন সময়ের অপেক্ষা, কর্মীদের নজর সুপ্রিম কোর্টের দিকে

ডিএ মামলার শুনানি এখনও চলছে। রাজ্যের সওয়াল ও কর্মীদের পক্ষে দেওয়া যুক্তির ভিত্তিতে বিচারপতিরা যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে—রায়দান খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হতে চলেছে। রাজ্যকে তার নিজের কথাই মানতে বলছে শীর্ষ আদালত। এখন দেখার, পরবর্তী শুনানিতে কীভাবে রাজ্য তার অবস্থান ব্যাখ্যা করে এবং আদালত কী সিদ্ধান্তে পৌঁছায়।

Leave a comment