ডায়াবেটিস এমন একটি অবস্থা যা আজকের দিনে সব বয়সের মানুষকে প্রভাবিত করছে। একদিকে যেমন এই রোগের কোনো স্থায়ী চিকিৎসা নেই, তেমনই জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন করে এটি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি নিয়মিতভাবে হাঁটা, অর্থাৎ ওয়াক করা, ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকরী উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়। এই নিবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে জানব যে ডায়াবেটিসের রোগীর প্রতিদিন কতক্ষণ হাঁটা উচিত, কত পদক্ষেপ নেওয়া উপকারী এবং হাঁটার সঠিক পদ্ধতি কী।
ডায়াবেটিসে হাঁটা: কেন এটি সবচেয়ে কার্যকরী ঔষধ হিসেবে বিবেচিত হয়?
ডায়াবেটিস (টাইপ ২ ডায়াবেটিস)-এ শরীরের কোষগুলি ইনসুলিনের সঠিক ব্যবহার করতে পারে না, যার ফলে রক্তের শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে, যদি শরীর সক্রিয় না থাকে, তবে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। হাঁটা শুধু একটি সহজ ব্যায়ামই নয়, এটি রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে এবং শরীরের ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায়। এই কারণেই ডাক্তাররা হাঁটাকে 'চলমান ঔষধ' বলেন।
ডায়াবেটিসে কতক্ষণ হাঁটা উচিত?
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য প্রতিদিন হাঁটা শুধু উপকারীই নয়, বরং প্রয়োজনীয়ও। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে:
- প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিটের জন্য হাঁটতে হবে।
- যদি একটানা ৩০ মিনিট হাঁটা সম্ভব না হয়, তবে এটিকে তিনটি অংশে ভাগ করতে পারেন – সকাল, দুপুর এবং সন্ধ্যায় ১০-১০ মিনিটের জন্য হাঁটা।
- ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য প্রতিদিন ৬,৪০০ থেকে ১০,০০০ পদক্ষেপ হাঁটা উপকারী বলে মনে করা হয়।
- যদি আপনি কিলোমিটারে মাপতে চান, তবে প্রতিদিন ৩ থেকে ৫ কিলোমিটার হাঁটা আপনার রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করতে পারে।
কোন সময়ে হাঁটা সবচেয়ে উপকারী?
আপনি দিনের যেকোনো সময় হাঁটতে পারেন, তবে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কিছু বিশেষ সময় আরও বেশি কার্যকরী বলে মনে করা হয়:
১. খাওয়ার পরে হাঁটা
- খাবার খাওয়ার ১৫-৩০ মিনিট পর হালকা হাঁটা রক্তের শর্করার মাত্রা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- বিশেষ করে রাতের খাবারের পরে হাঁটা ব্লাড সুগার স্পাইক(বৃদ্ধি) প্রতিরোধ করে।
২. সকালে খালি পেটে হাঁটা
- সকালে, নির্মল বাতাসে হাঁটা শরীরের অক্সিজেন সরবরাহকে উন্নত করে এবং মেটাবলিজমকে সক্রিয় করে।
- তবে আপনি যদি ইনসুলিন গ্রহণ করেন বা ব্লাড সুগার কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবে হাঁটার আগে হালকা জলখাবার খান।
৩. কাজের ফাঁকে হাঁটা
আপনি যদি দীর্ঘ সময় ধরে বসে কাজ করেন তবে প্রতি এক-দেড় ঘণ্টা অন্তর ৫-১০ মিনিটের জন্য হাঁটাও আপনার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হতে পারে।
কীভাবে হাঁটবেন: সঠিক পদ্ধতি জেনে নিন
হাঁটারও কিছু পদ্ধতি আছে যা অনুসরণ করে আপনি সুগার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আপনার সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারেন:
- দ্রুত গতিতে হাঁটুন – অর্থাৎ, এমনভাবে হাঁটুন যাতে আপনার শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়, তবে কথা বলতে পারেন।
- ধীরে ধীরে শুরু করুন – প্রথমে ৫ মিনিটের জন্য ধীরে হাঁটুন, তারপর ২০ মিনিট দ্রুত গতিতে এবং শেষে ৫ মিনিটের জন্য ধীরে হাঁটুন।
- জাপানি স্টাইলে হাঁটুন – ৫ মিনিট দ্রুত হাঁটা, তারপর ২ মিনিট ধীরে চলুন, এটি পুনরাবৃত্তি করুন।
- ১০-১০-১০ ফর্মুলা অনুসরণ করুন – দিনের ৩০ মিনিটের হাঁটাকে তিনটি ভাগে ভাগ করুন: সকাল, দুপুর এবং রাতে ১০-১০ মিনিট।
হাঁটার সময় কোন বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে?
- আরামদায়ক জুতা পরুন যাতে পায়ে ফোস্কা বা ব্যথা না হয়।
- একটি জলের বোতল সঙ্গে রাখুন, বিশেষ করে গরমকালে।
- রক্তের শর্করার মাত্রা নিরীক্ষণ করুন, বিশেষ করে যদি আপনি ওষুধ বা ইনসুলিন গ্রহণ করেন।
- হাঁটার সময়, একটি স্টেপ কাউন্টার অ্যাপ ব্যবহার করুন যাতে আপনি প্রতিদিন আপনার পদক্ষেপগুলি গণনা করতে পারেন।
- যদি দুর্বল লাগে, ঘাম হয় বা মাথা ঘোরায়, তবে অবিলম্বে হাঁটা বন্ধ করুন এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
কাদের হাঁটার সময় অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত?
- বৃদ্ধ বা হৃদরোগীদের হাঁটা শুরু করার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
- যদি আপনার পায়ে অসাড়তা, জ্বালাপোড়া বা আলসারের সমস্যা থাকে তবে হাঁটার আগে উপযুক্ত জুতা পরা এবং সতর্কতা অবলম্বন করা অপরিহার্য।
- ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি রোগীদের বেশি হাঁটা এড়ানো উচিত।
হাঁটার উপকারিতা শুধু সুগার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়
- রক্তের শর্করার নিয়ন্ত্রণ থাকে
- ওজন কমে
- কোলেস্টেরলের মাত্রা উন্নত হয়
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে
- মেজাজ ভালো থাকে এবং মানসিক চাপ কমে
- ঘুমের গুণগত মান উন্নত হয়
ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যা ঔষধের চেয়ে সুশৃঙ্খল জীবনযাত্রা এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। আর হাঁটা সবচেয়ে সহজ, সস্তা এবং কার্যকরী উপায়। প্রতিদিন ৩০ মিনিটের হাঁটা বা ৬,০০০ থেকে ১০,০০০ পদক্ষেপের অভ্যাস তৈরি করে আপনি শুধু সুগার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না, বরং আপনার জীবনকে আরও সুস্থ করতে পারবেন।