ফ্যাটি লিভার ডিজিজ হল এমন একটি স্বাস্থ্য সমস্যা যেখানে লিভারের উপর অতিরিক্ত মেদ জমা হয়। এটি শুধু লিভারের কার্যক্ষমতাকেই প্রভাবিত করে না, বরং পুরো শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ফ্যাটি লিভারের প্রধান কারণ স্থূলতা বা ওবেসিটি। এছাড়াও, অ্যালকোহল সেবন, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও অতিরিক্ত খাওয়া-দাওয়া রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ডায়াবেটিস ও খারাপ কোলেস্টেরল থাকলেও ফ্যাটি লিভার হতে পারে।
ফ্যাটি লিভার ডিজিজ: দুটি প্রধান প্রকার এবং তাদের ঝুঁকি
ফ্যাটি লিভার ডিজিজ মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে। প্রথমটি হল মেটাবলিক ডিসফাংশন-সম্পর্কিত স্টিয়াটোটিক লিভার ডিজিজ, যা সাধারণত ডায়াবেটিস, স্থূলতা এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের সঙ্গে যুক্ত। এই ধরনের লিভার সমস্যা শরীরের মেটাবলিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে এবং ধীরে ধীরে লিভারের কার্যক্ষমতা কমাতে পারে।দ্বিতীয় প্রকার হলো অ্যালকোহল-সম্পর্কিত ফ্যাটি লিভার ডিজিজ, যা অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে উদ্ভূত হয়। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেন, এই ধরনের লিভার সমস্যা প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা না পড়লে এটি মারাত্মক জটিলতা ডেকে আনতে পারে। ফলে সময়মতো সনাক্তকরণ ও চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি।
প্রাথমিক লক্ষণ: পেটের উপরের ডান পাশে ব্যথা
ফ্যাটি লিভার ডিজিজের প্রাথমিক চিহ্ন হল পেটের উপরের ডান পাশে ব্যথা ও অস্বস্তি। এটি সাধারণত অল্প অল্প শুরু হয়, তাই অনেকেই অবহেলা করেন। তবে দীর্ঘ সময় এই উপসর্গ থাকলে তা শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে প্রভাবিত করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন যে, পেটের উপরের ডান পাশে নিয়মিত ব্যথা হলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
পা ও গোঁড়ালিতে ফোলা: কিডনিতেও প্রভাব
ফ্যাটি লিভারের ফলে পা ও গোঁড়ালি ফুলে যাওয়া একটি সাধারণ লক্ষণ। লিভারের সমস্যা ধীরে ধীরে রক্তনালিতে চাপ তৈরি করে, যা কিডনির রক্তপ্রবাহে বাধা দেয়। ফলে কিডনি অতিরিক্ত তরল বের করতে ব্যর্থ হয়, পা ও গোঁড়ালি ফোলা শুরু হয়। অনেক সময় এটি সাধারণ ফোলা মনে হলেও, দীর্ঘ সময় অবহেলা করলে গুরুতর সমস্যায় পরিণত হতে পারে।
বুকের পেশি বৃদ্ধি: হরমোনের ভারসাম্যহীনতা
লিভারের সমস্যা শুধু পায়ে ফোলা বা পেট ফোলা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় বুকের দেওয়াল বা পেশি বেড়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে ঘটে। লিভারের কার্যক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে শরীরের হরমোন নিয়ন্ত্রণেও প্রভাব পড়ে, যা বিভিন্ন অস্বাভাবিক শারীরিক পরিবর্তন ডেকে আনে।
পেটে জল জমা: পেটে ফেঁপে যাওয়া ও ব্যথা
ফ্যাটি লিভার ডিজিজে লিভারের রক্তনালিতে প্রদাহ দেখা দিতে পারে। এর ফলে রক্তনালিতে চাপ বৃদ্ধি পায় এবং শরীরের তরল পেটের মধ্যে জমে যায়। এই অবস্থায় পেট ফেঁপে যায়, ব্যথা হয় এবং অস্বস্তি সৃষ্টি হয়। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, এটি লিভারের মারাত্মক ক্ষতির পূর্বাভাস হতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না করলে লিভারের ফাংশন ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ফ্যাটি লিভারের জন্য উপকারী ৭ খাবার
ফ্যাটি লিভারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুষ্টিকর খাবার গুরুত্বপূর্ণ। 'ইনস্টিটিউট অফ লিভার অ্যান্ড বিলিয়ারি সায়েন্স'-এর ডিরেক্টর ডঃ শিব কুমার সারিন বলছেন, বিশেষ কিছু খাবার লিভারের ফ্যাট কমাতে সাহায্য করে।
১. কাঁচা হলুদ – কাঁচা হলুদ লিভারের ফ্যাট কমাতে সহায়ক। তবে এটি থেঁতো করে খেতে হবে, রান্না করা উচিত নয়।
২. কফি – নিয়মিত কফি লিভারের ফ্যাট কমাতে সাহায্য করে।
৩. শস্যদানা – কম চিনি যুক্ত শস্য যেমন বাজরা, রাগি, ছাতু খাবেন। বেশি গম খাবেন না, কারণ গম দ্রুত রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
৪. কালো ছোলা – লিভারের জন্য অত্যন্ত উপকারী। খোসা ছাড়া খাবেন না।
৫. আখরোট – রোজ ৩০ গ্রাম আখরোট খেলে মাছের মতো পুষ্টি পাওয়া যায়।
৬. আপেল – খোসাসহ আপেল খেতে হবে। এতে থাকে ফাইবার, ভিটামিন সি, পটাশিয়াম, ভিটামিন কে ও কপার।
৭. রঙিন সবজি – বিট, বাঁধাকপি ইত্যাদি লিভারের জন্য খুব উপকারী।
নিয়মিত খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারায় পরিবর্তন
ফ্যাটি লিভার নিয়ন্ত্রণের জন্য শুধু সঠিক খাবারই নয়, জীবনধারার পরিবর্তনও অপরিহার্য। অতিরিক্ত মদ্যপান এড়ানো, নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও, ডায়াবেটিস ও উচ্চ কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে ফ্যাটি লিভারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো যায়।