ঝাড়গ্রামের বাঁশতলা স্টেশনের কাছে গভীর রাতে ঘটে গেল এমন এক ঘটনা, যা প্রাণকেন্দ্রে আঘাত হানে শুধু বনদপ্তর বা পরিবেশপ্রেমীদের নয়, বরং মনুষ্যত্বের। রাত একটা নাগাদ, যখন সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন জনশতাব্দী এক্সপ্রেস ঝাঁপিয়ে পড়ে তিনটি নিরীহ হাতির ওপর। একটি পূর্ণবয়স্ক হাতি ও দুটি শাবক—তাদের জীবনের গতি রেললাইনে গড়িয়ে আসা লোহা ও ইস্পাতের ধাতব দৈত্য থামিয়ে দেয় একঝটকায়।স্থানীয় সূত্র জানায়, সেই সময় বন দফতর এবং হুলা পার্টির সদস্যরা হাতিগুলিকে সরানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু মুহূর্তের ভুল এবং অসামঞ্জস্যে শেষ পর্যন্ত যা ঘটল, তা হল এক নির্মম প্রাণহানি। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, বন ও রেল বিভাগের মধ্যে কোনও সমন্বয় ছিল না। যার ফলে তৈরি হল একটি ‘ম্যান-মেড ট্র্যাজেডি’, যার জন্য দায় এড়ানো যায় না।এই অংশে তুলে ধরা হয়েছে মূল দুর্ঘটনার মুহূর্তটি, কীভাবে ঘটল ও কারা কারা যুক্ত ছিলেন। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগে—এই মৃত্যু এড়ানো যেত না কি?
হাতির শোক ও আত্মীয়বোধের নিদর্শন: মৃত্যুর পরদিন ফিরে এল ৪ গজরাজ, রেললাইনেই দাঁড়িয়ে খুঁজল প্রিয়জনদের
হাতি যে কেবল একটি বন্যপ্রাণ নয়, বরং এক গভীর অনুভূতির প্রতীক—তা আরও একবার প্রমাণ করল বাঁশতলার চারটি হাতি। দুর্ঘটনার পরদিন সকালেই, যেখানে প্রাণ হারিয়েছিল তাদের সঙ্গীরা, ঠিক সেই রেললাইনে ফিরে আসে এই চার গজরাজ। শোকাহত, নিঃসঙ্গ, বিষণ্ণ মুখে তারা দাঁড়িয়ে পড়ে রেল লাইনের মাঝখানে। চোখে যেন হাজার প্রশ্ন—“আমাদের আপনজন কোথায় গেল?”এই দৃশ্য কেবল হৃদয়বিদারক নয়, বরং এক প্রকারের সামাজিক শিক্ষা। হাতিরা শোক করে, তারা স্মৃতি ধরে রাখে, এবং সঙ্গীর অনুপস্থিতি বুঝতে পারে। এই আচরণ বারবার মানুষের বুদ্ধিমান-প্রাণীর গর্বে আঘাত হানে—কারণ আমরা তো এমনই! অথচ আমরাই বারবার এমন নির্মমতা সৃষ্টি করি।এই অনুচ্ছেদে হাতির সামাজিক কাঠামো, অনুভূতি ও পারস্পরিক সম্পর্কের দিক তুলে ধরা হয়েছে। পাঠক বুঝতে পারেন—এটি শুধুই পশুর মৃত্যু নয়, একটি পরিবার ভেঙে যাওয়ার গল্প।
মানবিকতা বনাম প্রযুক্তি: রেলের গতি, বনদপ্তরের তৎপরতা—কোথাও হারিয়ে গেল জীবন
একদিকে রেলের গতি, অন্যদিকে বনদপ্তরের প্রচেষ্টা। কিন্তু সেই সমন্বয়হীনতার মাঝেই চিরতরে থেমে গেল তিনটি প্রাণ। রেলমন্ত্রক বহুবার হাতি করিডরের কথা বলেছে। কোথাও বলা হয়েছে গতি কমাতে হবে, কোথাও শব্দ নিরোধক ট্রেন চালানোর কথা। কিন্তু বাস্তব বলছে—তাতে কোনও পরিবর্তন হয়নি।পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বহু অঞ্চলে এই ধরনের ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে। বাঁশতলা, আলিপুরদুয়ার, ডুয়ার্স, জলপাইগুড়ি—কতবার হাতির মরদেহ রেললাইনের পাশে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে! অথচ কোনো স্থায়ী সমাধান আজও নেই। প্রস্তাব থাকলেও বাস্তবায়ন নেই। যে গতি নিয়ে আমরা সভ্যতার গল্প বলি, সেই গতি নিয়ে হাতির বুক চিরে চলে যায় লৌহরথ।এই অংশে প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ এবং দীর্ঘদিনের ব্যর্থতা তুলে ধরা হয়েছে। এখান থেকে পাঠক বুঝতে পারবেন—এই মৃত্যু নতুন কিছু নয়, বরং এক পুরনো ব্যর্থতার ধারাবাহিকতা।
ট্রেন থামল, যাত্রী নামল, ছবি তুলল: শোকের মুহূর্তও হয়ে উঠল ‘স্মার্টফোনের ফ্রেমে বন্দি এক দৃশ্যপট’
সকালবেলায় যখন ৪টি হাতি রেললাইনে উঠে পড়ে, তখন আপ এবং ডাউন লাইনের বহু লোকাল ও এক্সপ্রেস ট্রেন আটকে পড়ে। যাত্রীরা প্রথমে অবাক হন, পরে কৌতূহলী হন। তারপর ট্রেন থেমে গেলে তারা নেমে আসে, হাতে মোবাইল, ক্যামেরা—ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক! যেন এটা কোনও সাধারণ দৃশ্য।এই অংশটি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক। যেখানে একটি প্রাণ তার আপনজনের খোঁজে রেললাইনে হাঁটছে, সেখানে কিছু মানুষ সেটিকে খুঁটিয়ে দেখছে, ছবি তুলছে, সেলফি নিচ্ছে। এটিই কি মানবিকতা? না কি অনুভূতির শূন্যতা?এই অনুচ্ছেদ মানুষের মানসিকতার অসংবেদনশীল দিক তুলে ধরে। সামাজিকভাবে এটি আমাদের আয়নার সামনে দাঁড় করায়।