আইওয়্যার সেক্টরের বড় এবং সুপরিচিত কোম্পানি লেন্সকার্ট তাদের বহু প্রতীক্ষিত আইপিও (প্রাথমিক শেয়ার ছাড়ার প্রস্তাব)-এর জন্য আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ নিয়েছে। কোম্পানিটি ভারতীয় সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অর্থাৎ সেবির কাছে তাদের ড্রাফট রেড হেরিং প্রসপেক্টাস (ডিআরএইচপি) জমা দিয়েছে। নথি অনুযায়ী, এই আইপিওর অধীনে লেন্সকার্ট ২,১৫০ কোটি টাকার নতুন ইকুইটি শেয়ার ইস্যু করবে, যেখানে ১৩.২২ কোটি শেয়ারের বিক্রয় প্রস্তাব (ওএফএস) রাখা হবে।
আইপিও-তে কারা শেয়ার বিক্রি করছেন
এই বিক্রয় প্রস্তাবে লেন্সকার্টের প্রতিষ্ঠাতা পীযূষ বনসল, নেহা বনসল, অমিত চৌধুরী এবং সুমিত কাপাহীর পাশাপাশি অনেক বড় বিনিয়োগকারী অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। এই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সফটব্যাঙ্কের এসভিএফ II লাইটবাল্ব (কেইম্যান), শ্রোডার্স ক্যাপিটাল প্রাইভেট ইকুইটি এশিয়া মরিশাস লিমিটেড, প্রেমজি ইনভেস্টের পিআই অপরচুনিটিজ ফান্ড II, টেমাসেক-এর ম্যাকরিচি ইনভেস্টমেন্টস, কেডারা ক্যাপিটাল ফান্ড II এলএলপি এবং আলফা ওয়েভ ভেঞ্চারস এলপি প্রধান।
এসভিএফ II লাইটবাল্ব প্রায় ২.৬ কোটি শেয়ার বিক্রি করবে। শ্রোডার্স ক্যাপিটাল ১.৯ কোটি শেয়ার বিক্রি করবে। একই সময়ে, পিআই অপরচুনিটিজ ফান্ড II প্রায় ৮৭ লক্ষ শেয়ার, ম্যাকরিচি ইনভেস্টমেন্টস ৭৮.৬ লক্ষ, কেডারা ক্যাপিটাল ৭৩.৬ লক্ষ এবং আলফা ওয়েভ ভেঞ্চারস ৬৬.৬ লক্ষ শেয়ার বিক্রি করতে চলেছে।
কবে এবং কিভাবে কোম্পানির শুরু
লেন্সকার্টের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল ২০০৮ সালে। ২০১০ সালে, কোম্পানি অনলাইন ব্যবসা শুরু করে এবং ২০১৩ সালে দিল্লিতে তাদের প্রথম রিটেল স্টোর খোলে। কোম্পানিটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে শুরু করলেও আজ এটি ভারতের ছোট-বড় শহরগুলিতে তাদের ফিজিক্যাল স্টোরের মাধ্যমেও গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে গেছে।
এই মুহূর্তে লেন্সকার্টের বিজনেস মডেল ডিজাইনিং, ম্যানুফ্যাকচারিং, ব্র্যান্ডিং এবং রিটেল বিক্রি পর্যন্ত বিস্তৃত। কোম্পানিটি তাদের ব্র্যান্ডগুলি নিজেরাই ডিজাইন করে এবং গ্রাহকদের আরও ভালো পরিষেবা দেওয়ার জন্য প্রযুক্তির সম্পূর্ণ ব্যবহার করে।
আইপিও থেকে পাওয়া অর্থ কোথায় ব্যবহার করা হবে
আইপিও থেকে সংগৃহীত ২,১৫০ কোটি টাকার একটি বড় অংশ কোম্পানির সম্প্রসারণে ব্যবহার করা হবে। কোম্পানির পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রায় ২৭২.৬ কোটি টাকা ২০২৯ অর্থবর্ষের মধ্যে ভারতে ৬২০টি নতুন কোম্পানি-মালিকানাধীন স্টোর খোলার জন্য খরচ করা হবে।
অন্যদিকে, ৫৯১.৪ কোটি টাকা বিদ্যমান কোকো (Company Owned Company Operated) আউটলেটগুলির লিজ ডিপোজিট হিসাবে রাখা হবে। এছাড়াও, ২১৩.৪ কোটি টাকা প্রযুক্তি এবং ক্লাউড অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এতে এআই (AI) ভিত্তিক ফুলফিলমেন্ট সিস্টেম এবং রোবোটিক লেন্স ল্যাবের সম্প্রসারণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
কোম্পানি ব্র্যান্ড প্রচার এবং মার্কেটিংয়ের উপরও বড় বাজি ধরতে চলেছে, যার জন্য ৩২০ কোটি টাকার বাজেট আলাদা করে নির্ধারণ করা হয়েছে।
মজবুত হয়েছে লেন্সকার্টের মুনাফা এবং ব্যবসা
কোম্পানির আর্থিক পারফরম্যান্সও ক্রমাগত ভালো হচ্ছে। ২০২৪ অর্থবর্ষে কোম্পানি যেখানে ১০.২ কোটি টাকার ক্ষতি রেকর্ড করেছিল, সেখানে ২০২৫ অর্থবর্ষে এই চিত্রটি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। কোম্পানি ২৯৭.৩ কোটি টাকার নিট মুনাফা অর্জন করেছে।
কোম্পানির অপারেশন থেকে রাজস্বও বেড়ে ৬,৬৫২.৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা গত বছরের তুলনায় ২২.৫ শতাংশ বেশি। ইবিআইটিডিএ (EBITDA) অর্থাৎ সুদ, কর, মূল্যহ্রাস এবং অ্যামোর্টাইজেশন-এর আগের আয়ও শক্তিশালী হয়েছে। ২০২৩ অর্থবর্ষে ইবিআইটিডিএ যেখানে ৩০২ কোটি টাকা ছিল, সেটি ২০২৪ সালে ৭৬৩ কোটি টাকা হয় এবং ২০২৫ সালে এই সংখ্যা ১,১১৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
দেশ এবং বিদেশে ছড়িয়ে থাকা নেটওয়ার্ক
আজ লেন্সকার্টের নেটওয়ার্ক শুধু ভারতেই সীমাবদ্ধ নয়। কোম্পানির মোট ২,৭২৩টি স্টোর রয়েছে, যার মধ্যে ২,০৬৭টি ভারতে এবং বাকি ৬৫৬টি স্টোর বিদেশি বাজারে অবস্থিত।
কোম্পানিটি এ পর্যন্ত ১০ কোটির বেশি অ্যাপ ডাউনলোড করেছে। গ্রাহকদের সন্তুষ্টি এবং পুনরায় কেনার ক্ষেত্রে লেন্সকার্ট দাবি করে যে ভারতে দুই বছরে ৯৮ শতাংশ রিপিট অর্ডার রেট রয়েছে।
প্রযুক্তিতে ক্রমাগত বিনিয়োগ এবং নতুন চিন্তা
লেন্সকার্ট শুধু চশমা বিক্রি করা কোম্পানি নয়, এখন এটি একটি টেক-ড্রাইভেন কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। কোম্পানি তাদের প্ল্যাটফর্মে এআই (AI) ভিত্তিক প্রস্তাবনা, রোবোটিক্স এবং স্মার্ট মিররের মতো ফাংশন ব্যবহার করছে। গ্রাহকদের অনলাইন এবং ইন-স্টোর উভয় অভিজ্ঞতাতেই নতুনত্ব এবং স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার চেষ্টা ক্রমাগত চলছে।
বাজারে প্রতিযোগিতা এবং সামনের পথ
ভারতে আইওয়্যার সেক্টরে প্রতিযোগিতা ক্রমাগত বাড়ছে। বিশেষ করে অনলাইন এবং অফলাইন উভয় ক্ষেত্রেই অনেক ব্র্যান্ড সক্রিয় হয়েছে। তা সত্ত্বেও, লেন্সকার্ট নিজেকে একটি প্রিমিয়াম এবং নির্ভরযোগ্য নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কোম্পানিটি এখন তাদের আইপিওর মাধ্যমে আরও মূলধন সংগ্রহ করে সামনের পরিকল্পনাগুলোকে বাস্তবায়িত করতে চলেছে।
ডিজিটাল থেকে ফিজিক্যাল, সব দিকেই শক্তিশালী অবস্থান
লেন্সকার্ট তাদের ব্যবসার মডেল-এ ডিজিটাল এবং ফিজিক্যাল উভয়কেই সমান গুরুত্ব দিয়েছে। কোম্পানির উদ্দেশ্য হল গ্রাহকদের যে কোনও স্থান থেকে, যে কোনও সময় উন্নত মানের আইওয়্যার সরবরাহ করা। এই কৌশলের কারণে কোম্পানি গ্রামীণ এলাকা থেকে শুরু করে মেট্রো শহর পর্যন্ত নিজেদের প্রসারিত করতে পেরেছে।