মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলা: প্রজ্ঞা ঠাকুর সহ ৭ অভিযুক্ত বেকসুর খালাস

মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলা: প্রজ্ঞা ঠাকুর সহ ৭ অভিযুক্ত বেকসুর খালাস

২০০৮ সালে মহারাষ্ট্রের মালেগাঁওয়ে একটি বড় বোমা বিস্ফোরণ হয়, যাতে একটি মোটরসাইকেলে বিস্ফোরণের ফলে ৬ জনের মৃত্যু হয় এবং প্রায় ১০১ জন আহত হন।

নয়াদিল্লি: মহারাষ্ট্রের মালেগাঁওয়ে ২০০৮ সালের বোমা বিস্ফোরণের ১৭ বছর পর বিশেষ এনআইএ আদালত বৃহস্পতিবার ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেছে। আদালত বিজেপি সাংসদ প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর, লেফটেন্যান্ট কর্নেল প্রসাদ পুরোহিত সহ সমস্ত সাত অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস করেছে। এই রায়ের সঙ্গে দেশের সবচেয়ে আলোচিত সন্ত্রাসবাদী মামলাগুলির মধ্যে একটির আইনি অধ্যায় শেষ হল।

এই কেসের শুরু একটি ভয়ঙ্কর বোমা বিস্ফোরণ দিয়ে, যা দেশের রাজনীতি, তদন্তকারী সংস্থা এবং বিচার ব্যবস্থাকে বহু বছর ধরে প্রভাবিত করেছে। আসুন বিস্তারিতভাবে জেনে নিই মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলাটি কী ছিল, এর তদন্ত কীভাবে হয়েছিল এবং আদালত কীসের ভিত্তিতে সমস্ত অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস করেছে।

২০০৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কী হয়েছিল?

২০০৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে, রমজান মাসে, মহারাষ্ট্রের নাসিক জেলায় অবস্থিত মুসলিম অধ্যুষিত শহর মালেগাঁওয়ের অঞ্জুমান চক এবং ভিকু চকের মধ্যে একটি মোটরসাইকেলে বিস্ফোরণ হয়। এই বিস্ফোরণটি রাত প্রায় ৯:৩৫ মিনিটে ঘটে। এই বিস্ফোরণে ৬ জনের প্রাণহানি হয় এবং ১০১ জনের বেশি মানুষ আহত হন। বিস্ফোরণটি একটি মসজিদের কাছে হয়েছিল, যার ফলে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে।

বিস্ফোরণের পর তদন্তের দায়িত্ব মহারাষ্ট্র অ্যান্টি টেরোরিজম স্কোয়াড (ATS)-কে দেওয়া হয়। এটিএস তদন্তের সময় জানতে পারে যে, এলএমএল ফ্রিডম মোটরসাইকেলে আইইডি ডিভাইস লাগিয়ে বিস্ফোরণটি ঘটানো হয়েছে। গাড়িটি পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, এর ইঞ্জিন এবং চ্যাসিস নম্বর মুছে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু ফরেনসিক তদন্তে জানা যায় যে এই বাইকটি সাধ্বী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের নামে রেজিস্টার্ড ছিল।

এর ভিত্তিতে ২০০৮ সালের ২৩ অক্টোবর প্রজ্ঞা ঠাকুরকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর এটিএস ১১ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগ করে যে, সকলে মিলে 'অভিনব ভারত' নামে একটি সংগঠন তৈরি করেছিল এবং এই বিস্ফোরণটি ঘটিয়েছিল।

এটিএস-এর দাবি: 'বদলার মানসিকতা থেকে হামলা'

এটিএস অভিযোগ করেছিল যে, অভিযুক্তরা মুসলিম চরমপন্থীদের জঙ্গি হামলার বদলা নেওয়ার উদ্দেশ্যে এই হামলা করেছিল। তদন্তে বলা হয় যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল প্রসাদ পুরোহিত কাশ্মীর থেকে আরডিএক্স এনে নিজের বাড়িতে রেখেছিলেন, যা বোমা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছিল। অভিযুক্ত সুধাকর চতুর্বেদীর বাড়ি থেকেও আরডিএক্স-এর চিহ্ন পাওয়ার দাবি করা হয়।

২০১১ সালে এই মামলা জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (NIA)-কে হস্তান্তর করা হয়। এনআইএ ২০১৬ সালে তাদের চার্জশিট দাখিল করে, যেখানে তারা বেশ কিছু বড় পরিবর্তন করে। এনআইএ অভিযুক্তদের উপর থেকে মহারাষ্ট্র কন্ট্রোল অফ অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যাক্ট (MCOCA)-এর অভিযোগ তুলে নেয় এবং বলে যে, এই আইনের অধীনে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল না।

চার্জশিটে এনআইএ প্রজ্ঞা ঠাকুর, শ্যাম সাহু, প্রবীণ তকলকি এবং শিবনারায়ণ কালসাঙ্গরাকে ক্লিনচিট দিয়ে আদালতকে তাদের বেকসুর খালাস করার আবেদন জানায়। যদিও, বাকি সাত অভিযুক্তের উপর মামলা চলতে থাকে।

অভিযুক্তদের নাম ও অভিযোগ

মামলায় যে সাত অভিযুক্তের বিচার চলেছিল, তারা হলেন:

  1. প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর (বিজেপি সাংসদ)
  2. লেফটেন্যান্ট কর্নেল প্রসাদ পুরোহিত
  3. মেজর রমেশ উপাধ্যায়
  4. অজয় রাহিরকর
  5. সুধাকর দ্বিবেদী
  6. সুধাকর চতুর্বেদী
  7. সমীর কুলকার্নি

এই সকলের উপর ইউএপিএ (Unlawful Activities Prevention Act) এবং আইপিসির ধারার অধীনে গুরুতর অভিযোগ ছিল, যার মধ্যে হত্যা, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার মতো বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল।

২০১৮ সালে বিচার শুরু, ২০২৫ সালে রায়

এই কেসের বিচার ২০১৮ সালে শুরু হয় এবং ১৯ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক শেষ হয়। জুলাই ২০২৫-এ বিশেষ এনআইএ আদালত সমস্ত সাত অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস করে দেয়। আদালত রায় দেওয়ার সময় বলে যে: অভিযোগকারী পক্ষ কঠিন এবং বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পেশ করতে অসমর্থ হয়েছে। এটা প্রমাণ করা যায়নি যে প্রজ্ঞা ঠাকুরের মোটরসাইকেল বিস্ফোরণে ব্যবহার করা হয়েছিল।

বিস্ফোরণটি মোটরসাইকেলে বিস্ফোরক রাখা হয়েছিল এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল, কিন্তু এর পক্ষে কোনও অবৈজ্ঞানিক বা প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছিল না। আদালত বলেছে, কোনও ধর্ম সন্ত্রাস বা হিংসাকে সমর্থন করে না। আদালত শুধুমাত্র নৈতিক ভিত্তি বা অনুমানের উপর ভিত্তি করে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারে না। কঠিন প্রমাণ থাকা আবশ্যক। আদালত আরও বলেছে যে, মেডিকেল প্রমাণে কারচুপি করা হয়েছে এবং আহতদের সংখ্যা ১০১ নয়, বরং ৯৫ ছিল।

Leave a comment