নারায়ণ মূর্তি: ভারতের প্রযুক্তি বিপ্লবের অগ্রদূত

নারায়ণ মূর্তি: ভারতের প্রযুক্তি বিপ্লবের অগ্রদূত

যখন ভারতে প্রযুক্তিগত বিপ্লব এবং বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতির কথা আসে, তখন নারায়ণ মূর্তির নাম সবার আগে মনে আসে। একটি ছোট শহর থেকে উঠে এসে কোটি কোটি ডলারের কোম্পানি ইনফোসিস-এর ভিত্তি স্থাপনকারী মূর্তি কেবল একজন সফল উদ্যোক্তা নন, বরং ভারতীয় যুবকদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর চিন্তা, মূল্যবোধ এবং নেতৃত্ব শৈলী আজও কর্পোরেট এবং শিক্ষাজগতে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হয়।

প্রারম্ভিক জীবন: যেখান থেকে শুরু

20 আগস্ট 1946 সালে কর্ণাটকের সিদলঘট্টায় জন্ম নেওয়া নাগাওয়ারা রামারাও নারায়ণ মূর্তি একটি মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে এসেছেন। শিক্ষাকে পরিবারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো। তিনি মহীশূরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করেন এবং পরে আইআইটি কানপুর থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা এবং মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা জীবন তাঁর ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা তৈরি করে দেয়।

কর্মজীবনের শুরু এবং প্রযুক্তিগত যাত্রা

নারায়ণ মূর্তি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন আইআইএম আহমেদাবাদে একজন গবেষণা সহযোগী হিসেবে, এবং দ্রুত তিনি প্রধান সিস্টেম প্রোগ্রামার হন। এখানে তিনি ভারতের প্রথম টাইম-শেয়ারিং কম্পিউটার সিস্টেমে কাজ করেন, যা তাঁকে প্রযুক্তি বিশ্বের গভীরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। এরপর তিনি পুনের পাটনি কম্পিউটার সিস্টেমে কাজ করেন, যেখানে তাঁর মনে একটি আলাদা স্বপ্ন জন্ম নেয়—ভারতকে প্রযুক্তিগত শক্তিতে পরিণত করা।

ইনফোসিস-এর প্রতিষ্ঠা: এক বিপ্লবের সূচনা

1981 সালে নারায়ণ মূর্তি তাঁর স্ত্রী সুধা মূর্তির দেওয়া ₹10,000 প্রাথমিক বিনিয়োগের মাধ্যমে ইনফোসিস-এর ভিত্তি স্থাপন করেন। তাঁর সাথে আরও ছয়জন সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, যাঁরা ভারতীয় আইটি শিল্পকে নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন। মূর্তি গ্লোবাল ডেলিভারি মডেলের ধারণাটিকে উৎসাহিত করেন, যেখানে ভারত থেকে বিশ্বজুড়ে সফটওয়্যার পরিষেবা সরবরাহ করা হতো।

তিনি 1981 থেকে 2002 সাল পর্যন্ত ইনফোসিসের সিইও হিসেবে এবং পরে 2002 থেকে 2011 সাল পর্যন্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 2011 সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন, কিন্তু 2013 সালে আবার কার্যনির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে ফিরে আসেন এবং 2014 সালে তিনি সম্পূর্ণরূপে ইনফোসিস থেকে বিদায় নেন।

দৃষ্টিভঙ্গী এবং নেতৃত্ব শৈলী

নারায়ণ মূর্তি সবসময় মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে নেতৃত্বকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন যে 'মূল্য-ভিত্তিক ব্যবসা-ই স্থায়ী হয়'। তিনি ইনফোসিসে কর্পোরেট সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং সততাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। তিনি গ্লোবাল ডেলিভারি মডেল তৈরি করেন, যা ভারতে আইটি আউটসোর্সিংকে নতুন মাত্রা দেয়।

বৈশ্বিক স্বীকৃতি ও সম্মাননা

নারায়ণ মূর্তি ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মশ্রী (2000) এবং পদ্মবিভূষণ (2008) -এর মতো মর্যাদাপূর্ণ নাগরিক পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। ফ্রান্স সরকার তাঁকে ‘লিজিওন অফ অনার’ এবং ব্রিটেন তাঁকে সিবিই (কমান্ডার অফ দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার) উপাধিতে সম্মানিত করে। এছাড়াও তিনি ফোর্বস, টাইম, এনডিটিভি এবং এশিয়ান অ্যাওয়ার্ডস-এর মতো মঞ্চে বহুবার ‘অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্ব’-এর খেতাব অর্জন করেছেন।

পারিবারিক জীবন

নারায়ণ মূর্তির স্ত্রী সুধা মূর্তি স্বয়ং একজন সুপরিচিত লেখিকা এবং সমাজকর্মী। তিনি ইনফোসিস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে শিক্ষা ও সমাজসেবার ক্ষেত্রে বিশাল অবদান রেখেছেন। তাঁদের দুই সন্তান—রোহন এবং অক্ষতা মূর্তি। অক্ষতা মূর্তির বিয়ে ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের সঙ্গে হয়েছে, যা নারায়ণ মূর্তির নাম আন্তর্জাতিক স্তরে আরও বেশি পরিচিতি এনেছে।

লেখনি ও চিন্তা

নারায়ণ মূর্তি একজন চিন্তাবিদও। তিনি 'এ বেটার ইন্ডিয়া: এ বেটার ওয়ার্ল্ড'-এর মতো অনুপ্রেরণামূলক বই লিখেছেন, যা তরুণ ও নতুন উদ্যোক্তাদের নেতৃত্ব, স্বচ্ছতা এবং নৈতিক ব্যবসার দিকে পরিচালিত করে।

আলোচিত মন্তব্য ও সমালোচনা

2025 সালে নারায়ণ মূর্তি বলেছিলেন যে ভারতের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য সপ্তাহে 70 ঘণ্টা কাজ করা উচিত। এই মন্তব্যের উপর অনেক বিতর্ক হয়—কেউ কেউ এটিকে দেশের উন্নতির জন্য সঠিক বলেছিলেন, আবার কেউ কেউ এটিকে অবাস্তব বলেছিলেন। তবে মূর্তির উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট—ভারতকে পরিশ্রমী, সুশৃঙ্খল এবং বিশ্ব প্রতিযোগিতার যোগ্য করে তোলা।

নারায়ণ মূর্তির জীবন আমাদের শেখায় যে সীমিত সম্পদ এবং সাধারণ পটভূমি থেকেও অসাধারণ উচ্চতা অর্জন করা যেতে পারে। তিনি ভারতীয় আইটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং লক্ষ লক্ষ যুবককে দেখিয়েছেন যে সঠিক চিন্তা, পরিশ্রম এবং সততার মাধ্যমে যে কোনও স্বপ্ন সত্যি করা সম্ভব। আজও তিনি কেবল একজন ব্যবসায়ী নেতা নন, বরং একজন অনুপ্রেরণাদায়ী আদর্শ— যিনি প্রতিটি যুবকের হৃদয়ে আশা জাগান।

Leave a comment