'নিকিতা রয়' এমন একটি সিনেমা যা ভয় এবং বিশ্বাসের মধ্যেকার মনস্তাত্ত্বিক খেলাকে খুব কার্যকরী এবং ভিন্ন আঙ্গিকে দেখায়। এই গল্প শুধু ভূত-প্রেত বা ভয়ের চেহারার মাধ্যমে ভয় দেখায় না, বরং এটি ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা ভয় এবং মানুষের দুর্বলতাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
- সিনেমা রিভিউ: নিকিতা রয়
- স্টার রেটিং: ৩.৫/৫
- পর্দায়: ১৮/০৭/২০২৫
- পরিচালক: কুশ সিনহা
- ধরণ: সুপারন্যাচারাল থ্রিলার
Nikita Roy Review: নিকিতা রয় আজ সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে এবং এর মাধ্যমে সোনাক্ষী সিনহা আবারও দর্শকদের তার অভিনয় দিয়ে মুগ্ধ করতে প্রস্তুত। পরিচালক হিসেবে কুশ সিনহার প্রথম প্রয়াসেই তিনি প্রমাণ করেছেন যে, ভৌতিক এবং থ্রিলার সিনেমা শুধুমাত্র ভয় দেখানোর জন্য নয়, বরং একটি শক্তিশালী বার্তা দেওয়ার জন্য উপস্থাপন করা যেতে পারে।
'নিকিতা রয়' শুধুমাত্র ভূত-প্রেত বা ভয়ের গল্প নয়, বরং এটি কুসংস্কার এবং সত্যের মধ্যেকার একটি গভীর লড়াইকে তুলে ধরে, যা দর্শকদের ভাবতে বাধ্য করে।
গল্পটি কেমন?
সিনেমার গল্পটি লন্ডন প্রবাসী দুই ভাই-বোন সোনাল রয় (অর্জুন রামপাল) এবং নিকিতা (সোনাক্ষী সিনহা)-কে ঘিরে আবর্তিত। তারা দুজনেই মনে করে যে, যুক্তি এবং বিজ্ঞানই হল আসল সত্য। তারা সমাজে ছড়িয়ে থাকা কুসংস্কার এবং ভণ্ড বাবার বিরুদ্ধে কাজ করে। সোনাল রয়ের লক্ষ্য হলো বিখ্যাত কিন্তু সন্দেহভাজন আধ্যাত্মিক গুরু অমরদেবের (পরেশ রাওয়াল) মুখোশ খুলে দেওয়া, কিন্তু রহস্যজনক পরিস্থিতিতে তার মৃত্যু হয়।
এটা কি হত্যা নাকি আত্মহত্যা? পুলিশ এটিকে আত্মহত্যা বলে মামলাটি বন্ধ করার চেষ্টা করে, কিন্তু দাদার প্রতি নিবেদিত নিকিতা কিছু সন্দেহ করে। নিকিতা তার বন্ধু জলি (সোহেল নায়ার)-এর সঙ্গে মিলে এই মৃত্যুর আসল কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। এই তদন্তের মধ্যে সে সোনালের বাড়িতে অদ্ভুত কিছু ঘটনা অনুভব করে, রহস্যময় আওয়াজ শুনতে পায় এবং তার ভাইয়ের রেখে যাওয়া একটি রেকর্ডিং থেকে কিছু সত্য জানতে পারে, যা তাকে হতবাক করে দেয়।
গল্পটি ধীরে ধীরে এমন এক মোড়ে এসে পৌঁছায়, যেখানে প্রশ্ন ওঠে অমরদেব কি একজন সাধারণ মানুষ, নাকি তার পিছনে কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তি কাজ করছে?
সিনেমা পরিচালনা এবং উপস্থাপন
কুশ সিনহা তার প্রথম সিনেমাতেই অসাধারণ পরিচালনা করেছেন। তিনি ভয় দেখানোর জন্য উচ্চ শব্দ বা ভীতিকর মেকআপের আশ্রয় নেননি, বরং প্রতিটি দৃশ্য ধীরে ধীরে তৈরি করে দর্শকদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছেন। সিনেমার সিনেমাটোগ্রাফি অসাধারণ। প্রতিটি ফ্রেমে সাসপেন্স এবং ভয়কে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন পবন কৃপালনী, যিনি তার থ্রিলার সিনেমার জন্য পরিচিত।
জবরদস্ত সিনেমাটোগ্রাফি, শক্তিশালী স্ক্রিনপ্লে এবং ধীরে ধীরে উন্মোচিত হওয়া রহস্য গল্পটিকে আকর্ষণীয় করে রেখেছে। লন্ডনের পরিবেশ এবং লোকেশনগুলিকে খুব সুন্দরভাবে ক্যামেরাবন্দী করা হয়েছে, যার ফলে প্রতিটি দৃশ্যে রহস্য এবং ভয়ের আবহ তৈরি হয়েছে।
অভিনয় কেমন ছিল?
১. সোনাক্ষী সিনহা (নিকিতা রয়ের চরিত্রে)
সোনাক্ষী সিনহা এই সিনেমায় তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিণত অভিনয় করেছেন। নিকিতার চরিত্রে তিনি কখনো আবেগপ্রবণ বোন, আবার কখনো নির্ভীক মহিলা, যে সত্যের জন্য যেকোনো ঝুঁকি নিতে পারে। সোনাক্ষী বেদনা, ভয়, জেদ এবং নিজের লক্ষ্যের জন্য লড়াইকে খুব দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই চরিত্রটি তার অভিনয় জীবনের একটি মাইলফলক হতে পারে।
২. পরেশ রাওয়াল (অমরদেবের চরিত্রে)
পরেশ রাওয়াল অমরদেবের চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যিনি একজন আধ্যাত্মিক গুরু এবং যাঁর সত্যতা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। পরেশ রাওয়াল তার চরিত্রে রহস্য, ভয় এবং চতুরতার এক অসাধারণ মিশ্রণ দেখিয়েছেন। তিনি প্রতিটি দৃশ্যে তার অভিব্যক্তি এবং শান্ত কিন্তু রহস্যময় ভঙ্গির মাধ্যমে দর্শকদের মনে গভীর ছাপ ফেলেন।
৩. সোহেল নায়ার (জলি'র চরিত্রে)
সোহেল নায়ার সোনাক্ষীর বন্ধু এবং প্রাক্তন প্রেমিকের চরিত্রে খুব ভালো অভিনয় করেছেন। তার চরিত্রটি সিনেমার আবেগপূর্ণ দিকগুলোকে শক্তিশালী করে, কিন্তু মূল রহস্যে কোনো বাধা সৃষ্টি করে না।
সিনেমার বিশেষত্ব
- স্ক্রিপ্ট এবং স্ক্রিনপ্লে: গল্পটিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে রহস্য এবং ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে।
- সিনেমাটোগ্রাফি: লন্ডনের গলি থেকে শুরু করে পুরোনো বাড়ি পর্যন্ত, প্রতিটি স্থানকে এত সুন্দরভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে যে, আপনাআপনি ভয়ের অনুভূতি সৃষ্টি হয়।
- পারফরম্যান্স: সোনাক্ষী এবং পরেশ রাওয়াল দুজনেই সিনেমাটিকে নিজেদের কাঁধে করে টেনে নিয়ে গেছেন।
- বার্তা: এই সিনেমাটি শুধু ভয় বা থ্রিলের জন্য নয়, বরং কুসংস্কার, ভণ্ড বাবা এবং সমাজে ছড়িয়ে থাকা ভণ্ডামির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বার্তা দেয়।
কেন দেখবেন 'নিকিতা রয়'?
আপনি যদি শুধু ভয়ের সিনেমার ভক্ত হন, তাহলেও এই সিনেমাটি আপনার ভালো লাগবে। আর যদি আপনি সিনেমায় সামাজিক বার্তা, ভালো গল্প এবং শক্তিশালী অভিনয় দেখতে চান, তাহলেও 'নিকিতা রয়' আপনাকে হতাশ করবে না।
এই সিনেমাটি সমাজে ছড়িয়ে থাকা কুসংস্কার এবং ভণ্ডামির ওপর একটি বড় আঘাত হানে এবং দেখায় যে, আসল ভয় বাইরে নয়, বরং আমাদের নিজেদের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে।