প্রসব পরবর্তী মায়ের স্বাস্থ্য ও যত্ন: সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি

প্রসব পরবর্তী মায়ের স্বাস্থ্য ও যত্ন: সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি

মা হওয়া একটি আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা, তবে এটি দায়িত্ব এবং শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের সাথে আসে। গর্ভাবস্থায় মহিলাদের স্বাস্থ্যের প্রতি যতটা মনোযোগ দেওয়া হয়, প্রসবের পর ততটাই মনোযোগ দেওয়া আরও জরুরি হয়ে পড়ে। বিশেষ করে স্তন্যদানকারী মায়েদের নিজেদের যত্ন নেওয়াকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, কারণ তাঁদের স্বাস্থ্যই শিশুর পুষ্টি এবং বিকাশের ভিত্তি।

১. প্রসবের পর প্রথম সপ্তাহ: কেবল বিশ্রাম নিন

প্রসবের পরপরই শরীর এবং মনের সবচেয়ে বেশি বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। প্রথম ৭ দিন শরীরের সেরে ওঠার সময়। এই সময়ে:

  • দিনে কমপক্ষে ১০-১২ ঘণ্টা বিশ্রাম নিন।
  • ভারী শারীরিক কাজ থেকে দূরে থাকুন।
  • হালকা গরম জল দিয়ে স্নান করুন এবং নিয়মিত শরীরে তেল মালিশ করুন।

এই প্রাথমিক যত্ন শরীরে বাত দোষকে স্থিতিশীল করতে এবং পেশীগুলিকে ভালো করতে সাহায্য করে।

২. পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার: শিশু এবং মা উভয়ের জন্য জরুরি

আপনি যা খাবেন, সেটাই দুধের মাধ্যমে শিশুর শরীরে যাবে। তাই, খাবার এমন হওয়া উচিত যা শক্তিদায়ক, সহজে হজমযোগ্য এবং পুষ্টিকর হয়।

প্রস্তাবিত খাদ্য তালিকা:

  • ঘি, মুগের ডাল, সবুজ শাকসবজি, তাজা ফল, শুঁঠ, মেথি, জোয়ান।
  • দুধ, ঘোল এবং তিলের ব্যবহার করুন।
  • হলুদ মেশানো দুধ এবং গমের লাড্ডু শরীরকে শক্তিশালী করে।
  • প্রতিদিন এক গ্লাস ছাতু বা বাদাম শেক খেতে পারেন।

যেসব জিনিস বর্জন করবেন:

  • ঠান্ডা জিনিস যেমন আইসক্রিম, কোল্ড ড্রিঙ্কস।
  • বাসি খাবার, ফাস্ট ফুড, ডিপ ফ্রাই করা খাবার।
  • অধিক মশলাযুক্ত খাবার।

৩. ঘুমের বিশেষ যত্ন: যখনই শিশু ঘুমাবে, আপনিও বিশ্রাম করুন

প্রসবের পর নতুন মায়েদের পর্যাপ্ত ঘুম হয় না, যার ফলে ক্লান্তি এবং খিটখিটে ভাব দেখা দিতে পারে। তাই যখনই শিশু ঘুমায়, মায়েরও কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া উচিত। রাতে ঘুমানোর আগে হালকা গরম দুধ পান করা এবং মোবাইল থেকে দূরে থাকা ঘুমকে আরও ভালো করে। পর্যাপ্ত ঘুম হলে শরীর দ্রুত সেরে ওঠে এবং মানসিক শান্তিও বজায় থাকে।

৪. শারীরিক যত্ন: বেলি র‍্যাপ এবং হালকা ব্যায়ামে ফেরা সহজ

প্রসবের পর পেট ঢিলা হয়ে যেতে পারে। এর জন্য আপনি বেলি র‍্যাপ বা পেটের ফিতা ব্যবহার করতে পারেন। এটি কেবল পেটকে সাপোর্ট দেয় না, বরং শরীরকে গরম এবং সুরক্ষিতও রাখে।

৩ সপ্তাহ পর থেকে আপনি শুরু করতে পারেন:

  • প্রানায়াম (অনুুলোম-বিলোম, ভ্রমরী)
  • হালকা স্ট্রেচিং
  • হাঁটাচলা (বাড়িতে বা ছাদে)

মনে রাখবেন, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো কঠিন ব্যায়াম করবেন না।

৫. মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন: নিজের সাথে কথা বলুন

নতুন মা হওয়ার পর ডিপ্রেশন, একাকীত্ব বা মানসিক অস্থিরতা আসাটা স্বাভাবিক। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে ভালোবাসতে শিখুন।

এই কাজগুলো করুন:

  • আপনার পছন্দের বই পড়ুন অথবা গান শুনুন।
  • ১৫ মিনিট ধ্যান (মেডিটেশন) করুন।
  • কোনো নির্ভরযোগ্য বন্ধু বা সঙ্গীর সাথে কথা বলুন।

যদি তখনও মানসিক সমস্যা বেশি হয়, তবে কোনো মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

৬. নিজের জন্য সময় বের করা জরুরি

নতুন মা হওয়ার পর বেশিরভাগ মহিলাই কেবল শিশুর দেখাশোনার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং নিজেদের জন্য সময় বের করতে ভুলে যান। কিন্তু এটা জরুরি যে আপনি প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট নিজের জন্য বের করুন। এই সময়ে আপনি যা খুশি করতে পারেন – যেমন হালকা যোগা করা, ত্বকের যত্ন নেওয়া, নিজের পছন্দের বই পড়া অথবা এমন কিছু করা যা আপনাকে ভালো লাগে। এমনটা করলে আপনার মন খুশি থাকবে এবং আপনি আবার সতেজ অনুভব করবেন।

৭. পরিবারের সহযোগিতা নিন, সবকিছু একা সামলাবেন না

নতুন মা হওয়ার পর সব কাজ একা করার প্রয়োজন হয় না। শিশুর দেখাশোনার পাশাপাশি বাড়ির কাজেও পরিবারের সাহায্য নেওয়া খুব জরুরি। স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি বা কোনো নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির সাহায্য নিয়ে আপনি ক্লান্তি এবং মানসিক চাপ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেন। যখন দায়িত্ব ভাগাভাগি হয়, তখন মা বিশ্রাম পান এবং তিনি শিশুর ভালোভাবে যত্ন নিতে পারেন। তাই সহযোগিতা চাইতে কখনও দ্বিধা করবেন না।

স্তন্যদানকারী মহিলাদের জন্য এটা বোঝা খুবই জরুরি যে তাঁদের স্বাস্থ্য, বিশ্রাম এবং মনের শান্তি শিশুর বিকাশে সরাসরি অবদান রাখে। তাই, মা নিজের জন্য সময় বের করুন, পুষ্টিকর খাবার খান, পর্যাপ্ত ঘুম নিন এবং সাহায্য নিতে সংকোচ করবেন না।

Leave a comment