শহরের প্রাণকেন্দ্রে সরকারি হাসপাতালের ভেতরে তরুণী চিকিৎসকের উপর নৃশংস অত্যাচার ও খুন—২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল এই ঘটনা। রাস্তায়, সোশ্যাল মিডিয়ায়, আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল “জাস্টিস ফর আরজি কর” স্লোগান। কারও নাম উঠে এসেছিল প্রতিবাদের প্রতীকে, কারও নাম জড়িয়েছিল জনরোষে। বছর ঘুরে সেই মুখগুলিই আজও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
সঞ্জয় রায়—সিভিক ভলান্টিয়ার থেকে যাবজ্জীবন
তদন্তে প্রথম গ্রেফতার হয় সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়। সিবিআই চার্জশিটে অভিযুক্ত প্রমাণিত হয়ে শিয়ালদা আদালত তাঁকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়। বর্তমানে প্রেসিডেন্সি জেলের বন্দি, বাগান পরিচর্যার কাজে দিন কাটছে। নিজের নির্দোষত্ব দাবি করে হাইকোর্টে আবেদন করেছেন, অপরদিকে সিবিআই চাইছে তাঁর ফাঁসি। সেপ্টেম্বরে একসঙ্গে শুনানি নির্ধারিত—আবার নতুন করে উত্তেজনা।
অভয়ার বাবা-মা—ন্যায়ের খোঁজে পথযাত্রী
ঘটনার রাতে ‘সুইসাইড’-এর কথা শুনে ভেঙে পড়েছিলেন প্রবীণ দম্পতি। তারপর থেকে রাজনীতি ও প্রশাসনের সঙ্গে লড়াই তাঁদের জীবনের নিত্যসঙ্গী। অভিযোগ—ঘটনা ধামাচাপা দিতে টাকা অফার হয়েছিল। কখনও কলকাতা, কখনও দিল্লি—রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী সকলের কাছেই পৌঁছেছেন তাঁরা। আজও মনে করেন, মেয়ের বিচার অধরা।
সন্দীপ ঘোষ—প্রিন্সিপাল থেকে বিতর্কের কেন্দ্র
ঘটনার সময় আরজি করের প্রিন্সিপাল সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে ওঠে প্রমাণ লোপাট ও আত্মহত্যার তত্ত্ব প্রচারের অভিযোগ। সিবিআই তাঁকে গ্রেফতার করে। পরে অন্য দুর্নীতি মামলায়ও জেলে পাঠানো হয়। বদলির নির্দেশ, জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিবাদ—সব মিলিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন প্রশাসনিক দায়বদ্ধতার প্রতীক।
অভিজিৎ মণ্ডল—তথ্যলোপাটের অভিযোগে ওসি
টালা থানার তৎকালীন ওসি অভিজিৎ মণ্ডল গ্রেফতার হয়েছিলেন হাসপাতালের সেমিনার রুম থেকে তথ্য মুছে ফেলার অভিযোগে। বর্তমানে জামিনে মুক্ত হলেও তাঁর নাম এই কেসে তদন্তে ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগের সঙ্গে জুড়ে আছে।
ডা. সুবর্ণ গোস্বামী—বিতর্কিত মন্তব্যে আলোচনায়
ফরেন্সিক রিপোর্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ঘটনাস্থলে ১৫০ মিলিলিটার তরল নমুনা পাওয়া গেছে—যা সম্ভাব্য একাধিক ধর্ষকের ইঙ্গিত। তাঁর বক্তব্য শাসক ঘনিষ্ঠদের কটাক্ষের লক্ষ্য হয়, তবুও আন্দোলনের সময় যুক্তিগ্রাহ্য মন্তব্যে জনমত কুড়িয়েছিলেন।
ডা. কিঞ্জল নন্দ—আন্দোলনের শিল্পী–চিকিৎসক
জুনিয়র ডাক্তারদের অনশনে, লালবাজার অভিযানে প্রথম সারিতে ছিলেন অভিনেতা-চিকিৎসক কিঞ্জল নন্দ। সোশ্যাল মিডিয়া ও ময়দানে সক্রিয় এই মুখকে বদলির চাপে পড়তে হলেও জনসমর্থন কমেনি।
ডা. অনিকেত মাহাতো—নবান্নে সরাসরি প্রশ্ন
মুখ্যমন্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা নিয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন করেছিলেন অনিকেত। আমরণ অনশনে অসুস্থ হয়ে ভর্তি হন, পরে পোস্টিং বিতর্কে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। তাঁর স্পষ্টভাষিতা আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
ডা. দেবাশিস হালদার—দৃঢ় যুক্তির কণ্ঠস্বর
চেক শার্ট, ঘন দাড়ি, স্পষ্ট বক্তব্য—দেবাশিস হালদার আন্দোলনের অন্যতম যুক্তিসম্পন্ন মুখ। নবান্ন থেকে কালীঘাট—প্রতিটি মঞ্চে শাসকের কাছে প্রশ্ন ছুড়েছেন। অনশন মঞ্চেও ছিলেন সামনের সারিতে।
ডা. আসফাকুল্লা নাইয়া—ঝাঁঝালো বক্তৃতায় উজ্জীবন
তাঁর বক্তৃতা আন্দোলনে নতুন উদ্দীপনা আনত। পরে পিজিটি হয়ে কাজের পরিচয়ে বিতর্ক তৈরি হয়, রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের শোকজও পান। তবু তিনি বলেন, বিতর্ক না হলে বুঝতাম আন্দোলন হয়নি।
রিমঝিম সিনহা—‘রাত দখল’-এর মুখ
‘রিক্লেম দ্য নাইট’ ক্যাম্পেনের মাধ্যমে রাজ্যজুড়ে মেয়েদের রাতের প্রতিবাদী মিছিলের ডাক দিয়েছিলেন। এই উদ্যোগ শাসকশিবিরে চাপ তৈরি করেছিল। এক বছর পর ফের সেই স্লোগানেই ডাক দিয়েছেন নতুন কর্মসূচির।
বিনীত গোয়েল—অভিযোগে অপসারিত পুলিশ কমিশনার
তৎকালীন নগরপাল বিনীত গোয়েলের অপসারণের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। অভিযুক্তের পরিচয় প্রকাশ করায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়, পরে আদালতে ক্ষমা চান। তবু তাঁর নাম এই কেসে ‘প্রশাসনিক ব্যর্থতা’র সঙ্গে থেকে গেছে।
নারায়ণস্বরূপ নিগম—স্বাস্থ্যসচিবের বিরুদ্ধে গর্জন
তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিবের গ্রেফতারির দাবি তোলেন আন্দোলনরত চিকিৎসকরা। অভিযোগ—দুর্নীতি ও প্রমাণ ধামাচাপা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অপসারণ মানেননি, আর তিনিও ডাক্তারদের কাজে ফেরার আহ্বান জানিয়ে গেছেন বারবার।এইভাবে, আরজি কর কাণ্ডের সেই মুখগুলি এক বছরের পরেও জনস্মৃতিতে জীবন্ত—কেউ ন্যায়বিচারের লড়াইয়ের প্রতীক, কেউ প্রশাসনিক দায়ের প্রতিফলন, আবার কেউবা জনরোষের চিহ্ন।