প্রত্যেক মানুষ কোনো না কোনো লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। কেউ ক্যারিয়ার নিয়ে অস্থির, কেউ সম্পর্ক থেকে ক্লান্ত, আবার কেউ নিজের কাছেই পরাজিত বোধ করছে। মহাভারতের যুদ্ধে যখন অর্জুন অস্ত্র ত্যাগ করেছিলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ যে কথাগুলো বলেছিলেন, সেগুলো শুধু সেই যুদ্ধের জন্য ছিল না। সেগুলো ছিল প্রতিটি যুগ, প্রতিটি মানুষের জন্য। সেই কথাগুলো আজও আমাদের জীবনের অনিশ্চয়তা, ভয়, ক্রোধ এবং ব্যর্থতার সঙ্গে লড়াই করার শক্তি জোগায়।
শ্রীকৃষ্ণের সেই ৮টি অমূল্য উপদেশ, যা জীবনের দিশা পরিবর্তন করে দেয়
১. ক্রোধ থেকে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়
ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে ক্রোধ থেকে ভ্রান্তি জন্মায়, তারপর স্মৃতি দুর্বল হয়, বুদ্ধির নাশ হয় এবং মানুষ নিজেকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। আজও যদি দেখা যায়, তাহলে রাগের বশে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোই সবচেয়ে বেশি অনুতাপের কারণ হয়। অনেক সম্পর্ক, ক্যারিয়ার এবং সুযোগ শুধুমাত্র এই একটি অনুভূতির কারণে নষ্ট হয়ে যায়।
২. মনের উপর জয়ই আসল জয়
শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, যে নিজের মনকে জয় করেছে, সেই-ই সত্যিকারের বিজেতা। মনই সবচেয়ে বড় বন্ধু, আবার সেই-ই সবচেয়ে বড় শত্রু হতে পারে। যে নিজের ইচ্ছা, লোভ, ভয় এবং মোহ-এর উপর নিয়ন্ত্রণ রাখে, তাকে কেউ হারাতে পারে না। আজকের এই ব্যস্ত জীবনে এই কথাটি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।
৩. ভুল সময়ে নীরবতাও ধ্বংসের কারণ হয়
অনেক সময় আমরা মনে করি চুপ থাকা, কথা বলার চেয়ে ভালো। কিন্তু যখন মূর্খরা কথা বলতে থাকে আর জ্ঞানী ব্যক্তিরা চুপ থাকেন, তখন ধ্বংস অনিবার্য। অফিসের মিটিং হোক বা বাড়ির সমস্যা, সময় মতো সঠিক কথা বলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
৪. জ্ঞানই হল আসল ঔষধ
আজকাল উদ্বেগ, রাগ, মানসিক চাপ—এগুলো প্রায় সকলের জীবনেই বিদ্যমান। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ বলেন, যেমন জল আগুনকে শান্ত করে, তেমনই জ্ঞান মনের অশান্তিকে দূর করে। বই পড়া, ধ্যান করা বা নিজের সঙ্গে সময় কাটানো—এগুলো আজকের যুগের ঔষধ নয়, বরং শ্রীকৃষ্ণের শেখানো জীবন-পদ্ধতি।
৫. ক্রোধকে দমন করবেন না, বুদ্ধির সঙ্গে প্রকাশ করুন
যখন আমরা আমাদের ভেতরের রাগ বছরের পর বছর ধরে চেপে রাখি, তখন তা মানসিক এবং শারীরিক দিক থেকে আমাদের অসুস্থ করে তোলে। শ্রীকৃষ্ণ বলেন, ক্রোধকে চেপে রাখার চেয়ে ভালো, তাকে সংযমের সঙ্গে প্রকাশ করা। সঠিক শব্দে, সঠিক সময়ে নিজের কথা বলাটাই হল একটি সুষম জীবনের চাবিকাঠি।
৬. নরকের তিনটি পথ: কামনা, ক্রোধ এবং লোভ
শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন যে, মানুষকে এই তিনটি দরজা থেকে দূরে থাকতে হবে। যে ব্যক্তি কামনা, ক্রোধ এবং লোভের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না, সে নিজেরই ধ্বংসের কারণ হয়। এই তিনটি গুণই মানুষকে নিচে নামায়, সে যে কোনো স্থানেই থাকুক না কেন।
৭. কর্মই ভাগ্যের নির্মাতা
অনেকে তাদের ব্যর্থতার জন্য ভাগ্যকে দোষ দেয়। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ স্পষ্টভাবে বলেন, ভাগ্য কর্মের দ্বারা গঠিত হয়। যদি আপনি হাত গুটিয়ে বসে থাকেন, তাহলে ভাগ্যও থেমে যাবে। যে নিরন্তর কর্ম করে, সেই-ই ভাগ্যের নির্মাণ করে।
৮. তৃপ্তিই আসল সুখ
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, মানুষের আকাঙ্ক্ষা কখনোই শেষ হয় না। কোটিপতিও আরও চায়, বিখ্যাত ব্যক্তিও আরও চায়। যতক্ষণ না আপনি সন্তুষ্টির অনুভূতি গ্রহণ করছেন, ততক্ষণ সুখের অন্বেষণ অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। "কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন"—এই শ্লোকটি শুধু ধর্মের কথা বলে না, বরং আজকের কর্মজীবনের দুনিয়ায় এটি সবচেয়ে প্রয়োজনীয় নীতি হয়ে উঠেছে।
শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ, আজকের জীবনে কীভাবে প্রযোজ্য
- কাজের অনিশ্চয়তা: যখন কিছু বোঝা না যায়, তখন কাজ করে যান। ফল অবশ্যই পাবেন।
- সম্পর্কের জটিলতা: রাগ সবকিছুকে খারাপ করে দেয়, ধৈর্য্য সবকিছুকে ভালো করে।
- মনের অশান্তি: মনকে নিয়ন্ত্রণ করলে জীবন সুষম হবে।
- লক্ষ্যে বাধা: পরিশ্রম বন্ধ হয়ে গেলে, ভাগ্যও থেমে যাবে।
প্রতিটি মুহূর্তে শ্রীকৃষ্ণের বাণী পথপ্রদর্শক
এই উপদেশগুলোতে কেবল ধর্মীয় ভাব নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ জীবনশৈলী লুকিয়ে আছে। এটি আজকের মানসিক চাপপূর্ণ পরিবেশে ততটাই কার্যকরী, যতটা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ছিল। পার্থক্য শুধু একটাই—তখন অর্জুন ময়দানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আজ আমরা নিজেদের যুদ্ধে আছি। আর যেমন অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনে জয়ী হয়েছিলেন, তেমনই আমাদের জয়ও এই কথাগুলো গ্রহণ করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে।