বর্ষাকালের আবহাওয়া একদিকে যেমন পরিবেশকে শীতলতা প্রদান করে, তেমনই আমাদের শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতাও সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে থাইরয়েড গ্রন্থি এই সময়ে বেশি সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। কম রোদ, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা এবং খাদ্যাভ্যাসের অনিয়ম এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। যোগগুরু স্বামী রামদেবের মতে, আয়ুর্বেদ ও যোগের মাধ্যমে থাইরয়েডকে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
থাইরয়েড কী এবং কেন হয় এই ভারসাম্যহীনতা?
থাইরয়েড গ্রন্থি গলার সামনে অবস্থিত এবং এটি T3 ও T4-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ হরমোন তৈরি করে। এই হরমোনগুলি আমাদের শক্তি, মেটাবলিজম, মানসিক ভারসাম্য এবং হৃদস্পন্দনকে নিয়ন্ত্রণ করে। যখন এই গ্রন্থির কাজ কমে যায় বা বেড়ে যায়, তখন দুটি অবস্থা তৈরি হয়:
- হাইপোথাইরয়েডিজম (Hypothyroidism): হরমোনের অভাব
- হাইপারথাইরয়েডিজম (Hyperthyroidism): হরমোনের আধিক্য
বর্ষা ও থাইরয়েড: সম্পর্ক কী?
বর্ষাকালে সূর্যের আলো কম পাওয়া যায়, যার ফলে শরীরে ভিটামিন ডি-এর অভাব হয় এবং মেজাজও ঘন ঘন পরিবর্তন হতে থাকে। এছাড়াও, এই সময়ে মানুষ বেশি ভাজাভুজি ও অস্বাস্থ্যকর খাবার খায়, যা হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে। এই কারণে বর্ষাকালে থাইরয়েডের সমস্যা বাড়ে, বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে, যার ফলে PCOD এবং হরমোনজনিত সমস্যাও হতে পারে।
থাইরয়েডের সাধারণ লক্ষণ
- অতিরিক্ত ক্লান্তি
- চুল পড়া
- মেজাজ খিটখিটে হওয়া বা অস্থিরতা
- ওজন বাড়া বা কমা
- অনিয়মিত হৃদস্পন্দন
- হাতে কাঁপুনি
- ঘুমের অভাব
- ত্বকের শুষ্কতা
রামদেবজির মতে থাইরয়েডের জন্য সেরা যোগাসন
- সর্বাঙ্গাসন—মাথা নিচে এবং পা উপরে রেখে ঘাড়ে রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়, যা গ্রন্থির সঠিক কার্যকারিতা নিশ্চিত করে।
- হলাসন—পা’কে মাথার পিছনে নিয়ে মেরুদণ্ডকে নমনীয় করে এবং হজম ও থাইরয়েড উভয়কে সক্রিয় রাখে।
- মৎসাসন—বুক ও গলা প্রসারিত করে টি-3, টি-4 হরমোনের প্রবাহকে স্থিতিশীল করে।
- উষ্ট্রাসন—উট-এর মতো ভঙ্গিতে পিছনের দিকে ঝুঁকে ফুসফুসকে প্রসারিত করে এবং ক্লান্তি কমায়।
- ভূজঙ্গাসন—সর্প মুদ্রায় কোমর তোলার মাধ্যমে কণ্ঠ ও অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি সক্রিয় হয়।
- পবনমুক্তাসন— হাঁটু পেটের উপর চেপে গ্যাসের সমস্যা দূর করে এবং ওজন কমাতে সহায়তা করে।
- সূর্য নমস্কার— একটানা ৬-১২ চক্র সম্পূর্ণ শরীরের ব্যায়াম, রক্ত সঞ্চালন ও সহনশীলতা বৃদ্ধি করে।
- প্রণব ধ্যান—‘ওঁ’ -এর গভীর উচ্চারণ পাঁচ মিনিট ধরে করলে মানসিক চাপ কমে এবং হরমোনগুলি ভারসাম্যপূর্ণ থাকে।
থাইরয়েডে কি খাবেন?
রামদেবজি বলেন, খাদ্যই ঔষধ। সঠিক খাদ্য গ্রহণ থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে প্রধান ভূমিকা পালন করে:
- তিসি বীজ: ওমেগা-3 এবং সেলেনিয়াম হরমোনকে স্থিতিশীল করে।
- নারকেল তেল: মাঝারি-শৃঙ্খল ফ্যাটি অ্যাসিড মেটাবলিজমকে ত্বরান্বিত করে; ১-২ চামচ খাবারে ব্যবহার করুন।
- যষ্টিমধু চূর্ণ: রাতে আধা চামচ উষ্ণ জলের সাথে; হাইপো-থাইরয়েডে উপকারী।
- মাশরুম: প্রাকৃতিক ভিটামিন-ডি এবং বি-ভিটামিনের মিশ্রণ।
- হলুদ-দুধ: ঘুমানোর আগে ২০০ মিলি হালকা গরম; প্রদাহ কমায়, ঘুমের উন্নতি ঘটায়।
- দারুচিনি জল: সকালে খালি পেটে দারুচিনি ফুটিয়ে জল তৈরি করে ১০০ মিলি ধীরে ধীরে পান করুন।
কোন জিনিসগুলি এড়িয়ে চলবেন?
ক্ষতিকর খাদ্য ও অভ্যাস:
- অতিরিক্ত চিনি এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার
- সাদা আটা, চাল
- বেক করা খাবার (কেক, কুকিজ)
- ভাজা খাবার
- কোल्ड ড্রিঙ্কস এবং ক্যাফিন
- অতিরিক্ত লবণ
আয়ুর্বেদিক ভেষজ উপায়
আয়ুর্বেদে এমন অনেক ভেষজ ও যোগিক পানীয় রয়েছে যা থাইরয়েডকে স্থিতিশীল করতে পারে:
- যষ্টিমধু চূর্ণ: সকাল-সন্ধ্যা আধা চামচ উষ্ণ জলের সাথে
- তুলসী-অ্যালোভেরা জুস: খালি পেটে ২০ মিলি
- অশ্বগন্ধা: রাতে গরম দুধে ১ গ্রাম
- ত্রিফলা চূর্ণ: রাতে হজমের জন্য, যা ওজন ও হরমোন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
- দারুচিনি জল: সকালে খালি পেটে পান করুন
সতর্কতা এবং চিকিৎসা তত্ত্বাবধান
- আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাগুলি সহায়ক, বিকল্প নয়। ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ বন্ধ করবেন না।
- গর্ভবতী, স্তন্যদানকারী মহিলা বা গুরুতর হৃদরোগ/ডায়াবেটিসের রোগীদের— যোগাসন ও ভেষজ শুরু করার আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
- থাইরয়েড ফাংশন টেস্ট (T3, T4, TSH) প্রতি ৬ মাস অন্তর বা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী করান।
বর্ষার আনন্দ উপভোগ করার সময় যোগা, সুষম খাদ্য এবং আয়ুর্বেদিক ঔষধকে দৈনন্দিন জীবনে অন্তর্ভুক্ত করুন। যোগগুরু রামদেবের দেওয়া এই সূত্রগুলি কফ-বাতকে নিয়ন্ত্রণ করে থাইরয়েড গ্রন্থিকে প্রাকৃতিকভাবে শক্তিশালী করে। নিয়মিত অভ্যাস এবং চিকিৎসা তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে আপনি ক্লান্তি, ওজন বৃদ্ধি এবং মেজাজের পরিবর্তন-এর মতো সমস্যাগুলি নিয়ন্ত্রণ করে সুস্থ, শক্তিশালী জীবন যাপন করতে পারেন।