২৩ জুলাই, রাজ্যসভায় প্রশ্নোত্তর পর্বের মঞ্চে উঠে এল এক বহুল চর্চিত বিষয় — বৈদিক গণিত। পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি সভাপতি তথা সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য সরাসরি জানতে চাইলেন, দেশে কতজন বৈদিক গণিতবিদ রয়েছেন, যাঁরা সক্রিয়ভাবে গবেষণা, পাঠদান বা প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত? পাশাপাশি, গত পাঁচ বছরে এই বিষয়ে কেন্দ্র কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেছে? শুধু দেশে নয়, বিদেশেও ভারতের প্রাচীন জ্ঞানপ্রবাহের প্রতিনিধি হিসেবে এই বিষয় কীভাবে তুলে ধরা হয়েছে — সেটিও ছিল প্রশ্নের পরিসরে। শমীক জানতে চেয়েছেন, কেন্দ্রীয়ভাবে কোনও নিয়ন্ত্রক সংস্থা কি গঠিত হচ্ছে? এবং কতগুলি রাজ্যে স্কুল পাঠক্রমে এই বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে?
জবাবে এগিয়ে এলেন সুকান্ত মজুমদার, তুলে ধরলেন কেন্দ্রের 'ভারতীয় জ্ঞানতন্ত্র' মডেল
এই প্রশ্নের জবাব দেন তাঁরই পূর্বসুরি তথা কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার। তিনি স্পষ্ট করে জানান, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ অনুসারে ভারতীয় জ্ঞানতন্ত্র প্রকল্পের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার ভারতের প্রাচীন জ্ঞান ও শাস্ত্রচর্চাকে আধুনিক শিক্ষার মূলস্রোতে আনার কাজ করছে। বৈদিক গণিত সেই প্রাচীন ধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবেই সেখানে জায়গা করে নিয়েছে। এই প্রকল্প শুধুমাত্র তাত্ত্বিক নয় — বাস্তবিক প্রয়োগে নানা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক গবেষণায় গুরুত্ব, বৈদিক গণিত চর্চায় গতি আনছে কেন্দ্র
মন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেবী অহল্যা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হয়েছে ‘জৈন গণিত কেন্দ্র’, আর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে ‘প্রাচীন ভারতীয় গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’। এরকম একাধিক প্রতিষ্ঠানে গবেষণার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে, যেখানে প্রাচীন ভারতীয় গাণিতিক চিন্তাকে আধুনিক প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করে নতুন পাঠ্যসামগ্রী তৈরি হচ্ছে। এই ধারা অনুযায়ী পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রকল্প আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে ‘এনআইএএস’-এ গণনা ও তথ্যবিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণা, এবং সূর্যসিদ্ধান্ত বা মাল্লিকার্জুন সূরি ও পরমেশ্বরের ব্যাখ্যার উপর তুলনামূলক অনুবাদচর্চা।
সাড়ে ২ কোটির বেশি অনুদান, পাঠ্যক্রম রচনাতেও উৎসাহ
গত তিন বছরে ভারতীয় গণিত ঐতিহ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্পে ভারতীয় জ্ঞানতন্ত্র প্রকল্পের অধীনে মোট ২.৬১ কোটি টাকা মঞ্জুর করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু গবেষণা নয় — অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ১৫টি ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম এবং দুটি পাঠ্যপুস্তক রচনার প্রকল্প। অর্থাৎ পাঠদানের ক্ষেত্রেও একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রের লক্ষ্য, শুধু প্রাচীন জ্ঞানের পুনরাবিষ্কার নয়, তাকে আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা।
UGC-র নির্দেশিকাতেই বৈদিক গণিতের ঠাঁই, সংস্কৃতি-ভিত্তিক শিক্ষার রূপরেখা স্পষ্ট
শুধু শিক্ষা মন্ত্রক নয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (UGC) ইতিমধ্যেই একটি বিশেষ নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে — ‘ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিভিত্তিক পাঠ্যক্রম প্রবর্তন’। সেখানে বৈদিক গণিত ছাড়াও জায়গা পেয়েছে সর্বজনীন মানবীয় মূল্যবোধ, যোগ, আয়ুর্বেদ, সংস্কৃত ভাষা, ভারতীয় সংগীত ও নৃত্য। এই নির্দেশিকাকে কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষানীতির একটা সাংস্কৃতিক দিশা হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বৈদিক গণিত শিক্ষায় কতদূর পৌঁছবে? প্রশ্ন এখনও রয়ে যায়...
যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এই উদ্যোগকে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সেতুবন্ধন হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, তবু বিরোধী রাজনৈতিক শিবির বা শিক্ষাবিদদের একাংশের মধ্যে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে — এই পদক্ষেপ যথেষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক কি না? এবং, এই চর্চার ব্যপ্তি ঠিক কতটা গভীরে পৌঁছচ্ছে? যদিও সংসদে সুকান্ত মজুমদারের জবাবেই স্পষ্ট, সরকার প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞানচর্চাকে 'সফট পাওয়ার'-এর হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করতে চাইছে আন্তর্জাতিক মহলে।