ভগবান শিবের স্বরূপ যতটা রহস্যময়, ততটাই গভীর। তাঁর মাথায় গঙ্গা, কপালে চাঁদ, গলায় সাপ, হাতে ত্রিশূল, এবং শরীরে বাঘের চামড়া—এই সবকিছু তাঁর অনন্য যোগী রূপের অংশ। শিবজিকে দিগম্বর বলা হয়, অর্থাৎ তিনি বস্ত্রহীন। কিন্তু তবুও তিনি সবসময় বাঘের চামড়ায় মোড়া থাকেন।
দারুকবনের কথা: ঋষিদের সাথে সাক্ষাৎ
এক পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, একবার ভগবান শিব দিগম্বর অবস্থায় ভিক্ষা করতে করতে দারুকবন দিয়ে যাচ্ছিলেন। এই বন তপস্বীদের এলাকা ছিল, যেখানে অনেক ঋষি তাঁদের পরিবারসহ বাস করতেন। যখন শিবজি সেখানে পৌঁছলেন, তখন তাঁর তেজস্বী এবং দিব্য রূপ দেখে ঋষিদের স্ত্রীরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলেন। তাঁরা তাঁর পেছন পেছন চলতে লাগলেন।
এই দৃশ্য দেখে ঋষিরা অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে গেলেন। তাঁদের মনে হল, এটা কোনো মায়াবী পুরুষ, যে তাঁদের স্ত্রীদের বিভ্রান্ত করছে। রেগে গিয়ে তাঁরা তাঁদের তামসিক শক্তি দিয়ে একটি ভয়ঙ্কর বাঘ উৎপন্ন করলেন এবং সেটিকে শিবজির উপর ছেড়ে দিলেন।
বাঘের উপর শিবজির জয়
সেই বাঘ অত্যন্ত উগ্র ছিল এবং শিবজির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু শিবজি তো ভোলেনাথ, তিনি संसार-এর সমস্ত শক্তির মালিক। তিনি সেই বাঘটিকে খুব সহজেই ধরে তার চামড়া ছাড়িয়ে নিলেন এবং সেই চামড়াটি নিজের শরীরে পরিধান করলেন। এই দৃশ্য দেখে ঋষিরা তাঁদের ভুলের অনুধাবন করতে পারলেন এবং শিবজির কাছে ক্ষমা চাইলেন।
শিবজির বস্ত্র নয়, বার্তা
বাঘের চামড়া কেবল শিবজির পোশাক নয়, এটা একটি গভীর প্রতীক। এটি সেই আত্মিক শক্তি এবং নিয়ন্ত্রণের পরিচায়ক, যা শিবজিকে অন্য সকল দেবের থেকে আলাদা করে তোলে। আসুন, এর পেছনের লুকানো ভাবটি বুঝি।
বাঘ কামনা ও ক্রোধের প্রতীক
বাঘকে হিন্দু ঐতিহ্য-এ নিষ্ঠুরতা, শক্তি, কামনা এবং হিংসার প্রতীক মনে করা হয়। শিবজি কর্তৃক বাঘকে পরাস্ত করে তার চামড়া পরিধান করা এটা দর্শায় যে তিনি এই তমোগুণী শক্তিগুলোর উপর পূর্ণ বিজয় লাভ করেছেন। তিনি কামনা, মোহ এবং ক্রোধের মতো বিকার থেকে অনেক দূরে।
বৈরাগ্যের ইঙ্গিত
শিবজি संसार-এর সঙ্গে যুক্ত নন। তিনি পর্বতগুলোতে বাস করেন, ভস্ম মাখেন, এবং কেবল ধ্যানে মগ্ন থাকেন। তাঁর বাঘছাল পরিধান করা এটা দেখায় যে তিনি ভৌতিক সুখ, বস্ত্র এবং আড়ম্বর থেকে মুক্ত। এটাই তাঁর বৈরাগ্য, যা তাঁকে যোগীদেরও যোগী বানায়।
শক্তির উপর নিয়ন্ত্রণের প্রতীক
বাঘকে জঙ্গলের রাজা মানা হয়—তেজী, শক্তিশালী এবং স্বাধীন। শিবজির বাঘের চামড়া পরিধান করা এই কথাটির প্রতীক যে তিনি প্রকৃতির সমস্ত শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। তিনি কেবল যোগের জোরেই অপরাজেয় নন, বরং বাহ্যিক শক্তিগুলোর উপরেও তাঁর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
দিগম্বর রূপের গূঢ় অর্থ
শিবজির বস্ত্রহীন হওয়া কোনো খারাপ বিষয় নয়, বরং এটি ব্রহ্মাণ্ড থেকে উপরে ওঠা চেতনার প্রতীক। তিনি পঞ্চভূত—পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু এবং আকাশ—থেকেও परे। তাঁর এই রূপ এই বার্তা দেয় যে যখন কোনো ব্যক্তি আত্মজ্ঞান লাভ করে, তখন তার কোনো বাইরের বস্ত্র বা পরিচয়ের প্রয়োজন হয় না।
ঋষিদের অজ্ঞানতা এবং তার শেষ
দারুকবনের কথা কেবল একটি লীলাময় প্রसंग নয়, বরং এটি এটাও দর্শায় যে যখন কোনো ব্যক্তি অহংকার এবং অজ্ঞানে ডুবে থাকে, তখন সে ঈশ্বরের স্বরূপকেও চিনতে পারে না। শিবজি কেবল ঋষিদের অজ্ঞানকেই প্রকাশ করেননি, বরং নিজের দিব্য রূপ দিয়ে তাঁদের বাস্তব জ্ঞানের পথও দেখিয়েছেন।