আকবর: এক মহান মোগল সম্রাটের জীবন ও কীর্তি

আকবর: এক মহান মোগল সম্রাটের জীবন ও কীর্তি

ভারতীয় ইতিহাসে অনেক সম্রাট এসেছেন, কিন্তু কয়েকজনই এমন ছিলেন যাঁরা শুধু সাম্রাজ্য বিস্তার করেননি, বরং মানুষের হৃদয়ও জয় করেছিলেন। মোগল সম্রাট আবুল-ফতেহ জালালুদ্দিন মুহম্মদ আকবর, যিনি সাধারণত আকবর মহান নামে পরিচিত, তেমনই একজন অনন্য শাসক ছিলেন। তিনি ক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তা, সহিষ্ণুতা এবং প্রশাসনিক দক্ষতার এক অসাধারণ সমন্বয় ঘটিয়ে শুধু বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেননি, বরং সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।

বংশ ও জন্মপরিচয়

আকবরের জন্ম ১৫ই অক্টোবর ১৫৪২ সালে, বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে অবস্থিত অমরকোট দুর্গে। সেই সময় তাঁর পিতা হুমায়ুন শেরশাহ সূরীর কাছে পরাজিত হয়ে নির্বাসনে ছিলেন এবং স্ত্রী হামিদা বানু বেগমের সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আকবরের জন্ম এমন এক সময়ে হয়েছিল যখন মোগল সাম্রাজ্য সংকটে ছিল, কিন্তু এই কঠিন সময়ই পরবর্তীতে আকবরকে একজন শক্তিশালী ও বিচক্ষণ শাসক হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছিল। আকবরের রক্তে দুটি মহান যোদ্ধা বংশ - তৈমুর লং এবং চেঙ্গিস খানের সংমিশ্রণ ছিল। পিতার দিক থেকে তিনি তৈমুরের বংশধর ছিলেন এবং মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল। এই কারণে আকবরের মধ্যে নেতৃত্ব, সাহস এবং রণকৌশলগত চিন্তাভাবনা জন্ম থেকেই বিদ্যমান ছিল। এই মহান উত্তরাধিকার তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং শাসনশৈলীতে সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।

শৈশব ও শিক্ষা

আকবরের শৈশব অনেক উত্থান-পতনের মধ্যে অতিবাহিত হয়েছিল, যে কারণে তিনি প্রথাগত শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। তাঁর জীবনের প্রথম বছরগুলো পারস্য এবং কাবুল সহ বিভিন্ন স্থানে কেটেছে, যেখানে তিনি বহুবার তাঁর কাকা-দের সঙ্গে ছিলেন। পড়াশোনায় তাঁর মন কম বসত, কিন্তু অশ্বারোহণ, তরোয়াল চালনা এবং শিকারের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল। শৈশবে তিনি একজন দক্ষ যোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন এবং এই গুণটি তাঁর শাসনেও কাজে লেগেছিল। যদিও তিনি নিজে বেশি পড়াশোনা করেননি, তবুও তিনি সবসময় পণ্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে থাকতেন। তিনি রাতে ঘুমানোর আগে কারও কাছ থেকে গ্রন্থ পাঠ করাতেন, যাতে শুনে জ্ঞান অর্জন করতে পারেন। তিনি বলেছিলেন, 'জ্ঞান পাঠ থেকে নয়, উপলব্ধি থেকে আসে।' এই চিন্তাভাবনার কারণে তিনি আজীবন শিখেছেন এবং একজন বিচক্ষণ ও দূরদর্শী শাসক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।

ক্ষমতা গ্রহণ ও পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ

যখন আকবরের বয়স মাত্র ১৩ বছর, তখনই তাঁর পিতা হুমায়ুনের মৃত্যু হয়। সেই সময় আকবর খুবই ছোট ছিলেন, তাই বৈরাম খান নামক একজন বুদ্ধিমান সেনাপতি তাঁর দেখাশোনা ও রাজকার্য পরিচালনার দায়িত্ব নেন। আকবরকে দিল্লির সিংহাসনে বসানো হয়, কিন্তু সেই সময়ে দেশের পরিস্থিতি ছিল খুবই কঠিন। চতুর্দিকে শত্রুদের দ্বারা বিপদ ছিল এবং মোগলদের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এই সময়ে হেমু নামক এক শক্তিশালী হিন্দু সেনাপতি দিল্লি দখল করে নিয়েছিলেন। কিন্তু আকবর ও বৈরাম খান মিলে ১৫৫৬ সালে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে হেমুকে পরাজিত করেন। এই জয়ের পর আকবরের অবস্থান সুদৃঢ় হয় এবং মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তি পুনরায় শক্তিশালী হয়। এই যুদ্ধকে আকবরের দীর্ঘ ও সফল শাসনের সূচনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

প্রশাসনিক দক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা

আকবর ছিলেন একজন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দক্ষ শাসক। তিনি তাঁর রাজ্যকে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করেন, যেগুলোকে 'সুবাহ' বলা হত। প্রতিটি সুবাহ-তে একজন প্রধান কর্মকর্তা থাকতেন, যাঁর পদ ছিল 'সুবাদার'। তাঁর সঙ্গে একজন দেওয়ান (যিনি অর্থ ও করের হিসাব রাখতেন) এবং একজন কাজী (যিনি বিচার করতেন) থাকতেন। এর ফলে পুরো রাজ্যের কাজকর্ম সহজে ও সঠিকভাবে চলত। আকবর 'মনসবদারী ব্যবস্থা' নামে একটি বিশেষ পরিকল্পনা শুরু করেন, যার অধীনে কর্মকর্তাদের পদ ও দায়িত্ব অনুযায়ী পদ দেওয়া হত। এই ব্যবস্থা খুবই কার্যকরী ছিল এবং এর মাধ্যমে শাসনে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা বজায় থাকত। আকবর সর্বদা সকল ধর্ম, জাতি ও বর্ণের মানুষকে সমান চোখে দেখতেন এবং কোনো ভেদাভেদ ছাড়াই ন্যায়বিচার করতেন। এই কারণেই মানুষ তাঁকে একজন ন্যায়পরায়ণ ও মহান শাসক হিসেবে শ্রদ্ধা করত।

ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও দীন-ই-ইলাহী

আকবর উপলব্ধি করেছিলেন যে, ভারতে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বাস করে, তাই একজন ভালো শাসকের সকল ধর্মের প্রতি সম্মান জানানো উচিত। এই ধারণা নিয়ে তিনি হিন্দুদের উপর আরোপিত তীর্থকর (১৫৬৩ সালে) এবং জিজিয়া কর (১৫৬৪ সালে) তুলে দেন, যা হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আনন্দের ঢেউ তোলে। আকবর সকল ধর্মের ভালো দিকগুলো একত্রিত করে একটি নতুন ধর্ম প্রবর্তন করেন, যার নাম ছিল দীন-ই-ইলাহী। এই ধর্মে কোনো নির্দিষ্ট ঈশ্বরের পূজা ছিল না, বরং এর উদ্দেশ্য ছিল সকল ধর্মের ভালো দিকগুলো গ্রহণ করা। যদিও এই ধর্ম বেশি বিস্তার লাভ করতে পারেনি, তবে এটি আকবরের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার মনোভাবকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।

রাজপুতদের সঙ্গে বৈবাহিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক

আকবর রাজপুতদের সঙ্গে বৈবাহিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে তাঁর সাম্রাজ্যকে আরও শক্তিশালী করেন। তিনি আমিরের রাজার কন্যা যোধাবাঈকে বিবাহ করেন, যা রাজপুতদের বিশ্বাস ও সমর্থন লাভ করতে সহায়ক হয়। এরপর রাজা মানসিং এবং ভগবন্ত দাসের মতো অনেক রাজপুত সরদার তাঁর দরবারে যোগ দেন এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হন। এই সম্পর্কের ফলে মোগল ও রাজপুতদের মধ্যে বিশ্বাস ও ঐক্য বৃদ্ধি পায়, যা সমগ্র সাম্রাজ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল।

শিল্পকলা, সাহিত্য ও স্থাপত্যের অনুরাগী

আকবরের শিল্পকলা ও সঙ্গীতে গভীর আগ্রহ ছিল। তাঁর দরবারে অনেক মহান শিল্পী ও পণ্ডিত ছিলেন, যাঁদের 'নবরত্ন' বলা হত। তাঁদের মধ্যে বীরবল, তানসেন, টোডরমল এবং আবুল ফজল-এর মতো ব্যক্তিরা ছিলেন। তানসেন ছিলেন একজন মহান গায়ক, যাঁর সঙ্গীতে আকবর খুবই প্রভাবিত ছিলেন এবং তাঁকে বিশেষ সম্মান দেওয়া হয়েছিল। আকবর বহু প্রাচীন গ্রন্থ ফার্সি, হিন্দি ও সংস্কৃতে অনুবাদ করিয়েছিলেন, যাতে সবাই তা বুঝতে পারে। তিনি ফতেপুর সিকরি, আগ্রা ফোর্ট এবং লাহোর ফোর্টের মতো সুন্দর স্থাপত্যও নির্মাণ করেছিলেন। এই স্থাপত্যগুলো আজও ভারতের শিল্পকলা ও স্থাপত্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি প্রমাণ করে যে, আকবর শুধু একজন যোদ্ধা ছিলেন না, বরং একজন শিল্প-অনুরাগী সম্রাটও ছিলেন।

আকবরের শেষ যাত্রা

২৭শে অক্টোবর ১৬০৫ সালে মহান মোগল সম্রাট আকবরের মৃত্যু হয়। তিনি তাঁর জীবনে ভারতে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, শক্তিশালী প্রশাসন এবং সাংস্কৃতিক ঐক্যের এক অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর আগ্রার কাছে অবস্থিত সিকান্দ্রায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়, যেখানে তাঁর বিশাল সমাধিসৌধ আজও বিদ্যমান। এই সমাধিসৌধ কেবল তাঁর সম্মানের প্রতীক নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও তাঁর মহত্ত্বের স্মৃতি বহন করে।

আকবর শুধু যুদ্ধ জয়ী বাদশাহ ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন মানুষের হৃদয়ে বসবাসকারী এক মহান সম্রাট। তাঁর চিন্তা-ভাবনা ছিল সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে - তিনি ধর্ম, জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে 'ভারত'-কে একত্রিত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং তা বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন। তাঁর নীতিগুলি আজও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং মানবতার মূল্যবোধের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।

Leave a comment