‘অশ্বিনে রাঁধে, কার্তিকে খায়’— লোকবিশ্বাসের সঙ্গে কৃষির যোগ : প্রবাদ আছে— “অশ্বিনে রাঁধে, কার্তিকে খায়, যেই বর মাগে সেই বর পায়।” এই নিয়মে পালন করা হয় গারু সংক্রান্তির ব্রত। বিশ্বাস, এই দিনে নির্দিষ্ট উপায়ে রান্না করা ডাল খেলে জীবনের অশুভ শক্তি দূর হয় এবং মনের বাসনা পূর্ণ হয়। এই সংক্রান্তি হেমন্তের আগমনী উৎসব, কৃষি, প্রকৃতি ও পারিবারিক ঐক্যের প্রতীক।

কবে ও কিভাবে পালিত হয় গারু সংক্রান্তি
আশ্বিন মাসের শেষ দিনে, অর্থাৎ আশ্বিন সংক্রান্তিতে, পালিত হয় এই বিশেষ ব্রত। ভোরে স্নান সেরে তুলসীতলা পরিষ্কার করে শুরু হয় আচার। বাড়ির মেয়ে-বউরা সকালে গারুর ডাল রান্না করেন। ব্রতের শেষে সকলেই এই ডাল খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করেন। মূলত ধানশীষ ওঠার সময় এই সংক্রান্তি পালিত হয়, তাই একে বলা হয় হেমন্তের সূচনা উৎসব।
গারুর ডালের উপকরণ: কচু, শাপলা, তেঁতুলে গড়া পুষ্টির ঐতিহ্য
এই ডালের বৈশিষ্ট্য এর উপকরণে। মটর, খেসারি, আলু, পটল, ঝিঙে, মুলো, কুমড়ো, গাঠি কচু, শাপলা, এমনকি জঙ্গলের আলুও এতে মেশানো হয়। বুড়ো হলুদ নয়, ব্যবহার করা হয় বাটা কাঁচা হলুদ। লোকবিশ্বাস, যত প্রকার সবজি এই ডালে থাকবে, তত রকম ফসলের ফলন হবে বছরভর ভালো।

ব্রতের নিয়মে নিষিদ্ধ তেল ও হলুদ
গারুর ডালে কচু অপরিহার্য উপাদান— মান কচু, দুধ কচু, কৃষ্ণ কচু সবই থাকে এই রান্নায়। তবে ব্রতের বিশেষ নিয়ম অনুযায়ী এই দিনে তেল ও পাকা হলুদ ব্যবহার নিষিদ্ধ। তুলসীতলায় ঘটে জল রাখা হয়, বিজোড় সংখ্যার আম্রপল্লব দিয়ে সাজানো হয় এবং নুন দিয়ে আঁকা হয় স্বস্তিক চিহ্ন— শুভ শক্তির আহ্বানে।

‘বুরা গিয়া ভালা আ’— পুজোর শেষে ঐতিহ্যবাহী মন্ত্রধ্বনি
পুজোর ভোগে থাকে ডাল, নারকেল, কলা ও নানা ফল-মিষ্টি। সংক্রান্তি শেষে উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনির সঙ্গে উচ্চারিত হয় ঐতিহ্যবাহী মন্ত্র—
“বুরা গিয়া ভালা আ, আপদ বালাই দূরে যা, মশা মাছি দূরে যা।”
এই মন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে মানুষ প্রার্থনা করে, সব অশুভ শক্তি দূরে যাক, নতুন ঋতু আনুক শান্তি ও সমৃদ্ধি।

গারু সংক্রান্তি শুধু একটি ব্রত নয়— এটি গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে মিশে থাকা প্রকৃতি, কৃষি ও পারিবারিক ঐক্যের প্রতীক। হেমন্তের হিমেল হাওয়ার ছোঁয়ায় বাংলার ঘরে ঘরে আজও বাজে ঐতিহ্যের সুর। আধুনিকতার ভিড়েও এই লোকাচার মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অটুট সম্পর্ক আজও অক্ষুণ্ণ।













