ঝাড়খণ্ডের দেওঘর জেলায় অবস্থিত বৈদ্যনাথ ধাম দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এটি সেই তীর্থস্থান যেখানে একদিকে ভগবান শিবের আত্মলিঙ্গ, অন্যদিকে শক্তিপীঠ রূপে মাতা সতীর হৃদয়ও প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করা হয়। এই কারণেই এই স্থানটিকে ‘হৃদয় পীঠ’ এবং ‘কামনা লিঙ্গ’ উভয়ই বলা হয়। দেওঘরের ভক্তরা এই ধামকে বাবা বৈদ্যনাথের নামে জানেন।
শাস্ত্রে বর্ণিত মূল জ্যোতির্লিঙ্গ
শিবপুরাণ এবং স্কন্দপুরাণের মতো প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে এই ধামের মহিমা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। পুরাণগুলিতে বর্ণিত আছে যে আত্মলিঙ্গ থেকে যে ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, তাদের মধ্যে দেওঘরে অবস্থিত বৈদ্যনাথ ধামের শিবলিঙ্গ মূল লিঙ্গ রূপে পূজনীয়। এই বিশ্বাস হাজার বছর ধরে চলে আসছে, এবং এই বিশ্বাসের সঙ্গে প্রতি বছর শ্রাবণ মাসে লক্ষ লক্ষ শিবভক্ত এখানে আসেন।
কীভাবে বৈদ্যনাথ নাম হল, তীর্থ পুরোহিতের মুখ থেকে শুনুন
দেওঘরে বহু প্রজন্ম ধরে পূজা-অর্চনা করে আসা প্রবীণ তীর্থ পুরোহিত পণ্ডিত দুর্লভ মিশ্র জানান, বৈদ্যনাথ নামের পেছনে পৌরাণিক কাহিনী জড়িত। তাঁর মতে, যখন সতী দক্ষ প্রজাপতির যজ্ঞে যোগাগ্নিতে আত্মাহুতি দেন, তখন ভগবান শিব তাঁর দেহ নিয়ে তাণ্ডব শুরু করেন। তখন ভগবান বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহের ৫২টি টুকরো করেন, যা বিভিন্ন স্থানে পতিত হয়। দেওঘরে সতীর হৃদয় পড়েছিল, তাই এটিকে হৃদয় পীঠ হিসাবে মানা হয়।
শিব এই স্থানগুলির রক্ষার জন্য সেখানে ভৈরবকে নিযুক্ত করেন। দেওঘরে যে ভৈরবকে মোতায়েন করা হয়েছিল, তাঁকে ‘বৈদ্যনাথ’ বলা হত। এর ভিত্তিতে এই স্থানের নাম বৈদ্যনাথ হয় এবং এখানকার শিবলিঙ্গকে বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ বলা হতে শুরু করে।
রাবণ ও আত্মলিঙ্গের কাহিনীর সঙ্গে জড়িত বৈদ্যনাথ ধাম
ত্রেতা যুগের আরও একটি আকর্ষণীয় কাহিনী এই জ্যোতির্লিঙ্গের সঙ্গে জড়িত। কথিত আছে, লঙ্কার রাজা রাবণ শিবের পরম ভক্ত ছিলেন। রাবণ ভগবান শিবকে তুষ্ট করে তাঁর কাছ থেকে আত্মলিঙ্গ লাভ করেন এবং সেটি লঙ্কায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শিব রাবণের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন যে তিনি এই লিঙ্গটিকে কোনো অবস্থাতেই পথে রাখবেন না, অন্যথায় যেখানে রাখবেন সেখানেই এটি স্থাপিত হয়ে যাবে।
যখন রাবণ দেওঘরের কাছে পৌঁছালেন, তখন তাঁর লঘুপাত হল। সেই সময়ে ভগবান বিষ্ণু এক রাখালের রূপ ধারণ করে রাবণের কাছে শিবলিঙ্গটি ধরার জন্য অনুরোধ করেন। রাবণ চলে যাওয়ার পরে বিষ্ণু শিবলিঙ্গটিকে ভূমিতে স্থাপন করেন, এবং সেটি সেখানেই স্থাপিত হয়। কথিত আছে, এটি সেই স্থান যেখানে সতীর হৃদয় পড়েছিল। এইভাবে বৈদ্যনাথ ধামে আত্মলিঙ্গের প্রতিষ্ঠা হয়।
কষ্টকর যাত্রা এবং শ্রদ্ধার ঝলক
শ্রাবণ মাসে বাবা বৈদ্যনাথের মহিমা দেখার এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়। লক্ষ লক্ষ কাওাড়িয়া (যারা পবিত্র জল বহন করে) সুলতানগঞ্জ থেকে জল ভরে ১০৫ কিলোমিটারের কঠিন পদযাত্রা করেন এবং দেওঘরে পৌঁছে বাবার অভিষেক করেন। এই সময় ‘বোল বোম’ এবং ‘হর হর মহাদেব’ ধ্বনিতে পুরো এলাকা মুখরিত হয়।
এই যাত্রা কেবল একটি প্রথা নয়, বরং এটি আস্থার পরীক্ষা হিসাবে বিবেচিত হয়। শোনা যায়, এই যাত্রায় যে ব্যক্তি খাঁটি মন নিয়ে অংশ নেয়, তার মনোবাসনা পূর্ণ হয়। এই কারণে প্রতি বছরের মতো এবারও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা বাবার শরণাপন্ন হচ্ছেন।
প্রাচীন মন্দির এবং তার বিশেষ স্থাপত্যশৈলী
বৈদ্যনাথ ধামের মন্দির প্রাঙ্গণ একটি বিশাল এলাকায় বিস্তৃত। মূল মন্দির ছাড়াও এখানে আরও ২১টি মন্দির রয়েছে, যার মধ্যে লক্ষ্মী-নারায়ণ, মা পার্বতী, কাল ভৈরব, গণেশ এবং অন্যান্য দেবী-দেবতাদের মন্দির অন্তর্ভুক্ত। মূল শিবলিঙ্গ গর্ভগৃহে অবস্থিত, যেখানে জল, দুধ, বেলপাতা, ধুতরা এবং ভস্ম দিয়ে অভিষেক করা হয়।
মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী নাগর শৈলীর এবং এটি বিভিন্ন রাজার দ্বারা বহুবার পুনর্নির্মিত হয়েছে। মন্দিরের উচ্চতা প্রায় ৭২ ফুট এবং এর চূড়ায় ত্রিশূল ও কলস স্থাপন করা আছে।
শ্রাবণে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয়
শ্রাবণ মাস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেওঘরের এই ধাম প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ ভক্তে ভরে যায়। বিশেষ করে সোমবার এখানে ভক্তদের সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়। এই উপলক্ষে স্থানীয় প্রশাসন এবং মন্দির কমিটি বিশেষ প্রস্তুতি নেয়, যাতে অভিষেক ও দর্শনের প্রক্রিয়া সহজ হয়।