বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন: এক যুগস্রষ্টার জীবন ও কর্ম

বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন: এক যুগস্রষ্টার জীবন ও কর্ম

বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন কেবল একটি নাম নয়, বরং এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি তাঁর চিন্তা, উদ্ভাবন এবং কাজের মাধ্যমে আমেরিকার নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি লেখক ছিলেন, বিজ্ঞানী ছিলেন, আবিষ্কারক ছিলেন, কূটনীতিক ছিলেন এবং সর্বোপরি একজন চিন্তাবিদ ছিলেন, যিনি সমাজকে নতুন দিশা দেখাতে সক্ষম ছিলেন। ফ্র্যাঙ্কলিনের গল্প কোনো একটি ক্ষেত্রে সাফল্য পাওয়ার নয়, বরং এটি সেই কৌতূহল এবং নিষ্ঠার গল্প যা জীবনের প্রতিটি দিককে প্রভাবিত করে।

প্রাথমিক জীবন: সংগ্রামের মধ্যে সংকল্প

বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন ১৭০৬ সালের ১৭ জানুয়ারি ম্যাসাচুসেটস বে কলোনির বোস্টন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা জোসিয়া ফ্র্যাঙ্কলিন ছিলেন মোমবাতি ও সাবান প্রস্তুতকারক। বেঞ্জামিন ছিলেন মোট ১৭ ভাই-বোনের মধ্যে পঞ্চদশ। তাঁর বাবা তাঁকে পাদ্রী বানাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে তিনি তাঁকে মাত্র দুই বছর স্কুলে পাঠাতে পেরেছিলেন। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল এক আত্মনির্ভর এবং জ্ঞানের প্রতি পিপাসু বালকের যাত্রা, যে পরবর্তীতে বিশ্বকে বদলে দিয়েছিল।

শিক্ষা এবং আত্মনির্ভরতা: বই থেকে পাওয়া দিশা

স্কুল ছাড়ার পরেও ফ্র্যাঙ্কলিনের পড়াশোনা থামেনি। তিনি বইয়ের মাধ্যমে নিজেকে শিক্ষিত করেন এবং জেমস নামক এক ভাইয়ের সাথে একটি প্রিন্টিং প্রেসে শিক্ষানবিশ হন। যখন তিনি নিজের মতামত প্রকাশের সুযোগ পাননি, তখন তিনি 'সাইলেন্স ডোগুড' ছদ্মনামে লেখা লিখতে শুরু করেন। তাঁর লেখা এত জনপ্রিয় হয়েছিল যে বোস্টনের নাগরিকরা তাঁকে একজন প্রাজ্ঞ মহিলা মনে করতেন। এটাই ছিল তাঁর লেখনীর শক্তি, যা পরবর্তীতে তাঁকে একজন প্রভাবশালী সম্পাদক ও লেখক করে তোলে।

ফিলাডেলফিয়ার দিকে যাত্রা এবং আত্মনির্ভরতার উড়ান

১৭ বছর বয়সে ফ্র্যাঙ্কলিন ফিলাডেলফিয়া যান এবং প্রিন্টিং শপে কাজ করতে শুরু করেন। এরপর লন্ডন ভ্রমণ করেন, যেখানে তিনি প্রতারিত হয়েছিলেন কিন্তু তিনি এটিকে শেখার সুযোগ হিসেবে দেখেন। লন্ডন থেকে ফিরে তিনি হিউ মেরেডিথের সাথে মিলে একটি প্রিন্টিং প্রেস শুরু করেন এবং 'পেন্সিলভেনিয়া গেজেট' নামক সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। এখান থেকেই তাঁর নাম পুরো উপনিবেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং বিস্ময়কর আবিষ্কার

ফ্র্যাঙ্কলিনের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর জীবনের বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি বিদ্যুতের উপর পরীক্ষা করে 'বিদ্যুৎ নিরোধক দণ্ড' (Lightning Rod) আবিষ্কার করেন, যা লক্ষ লক্ষ জীবন বাঁচিয়েছে। তিনি বাইফোকাল চশমা, গ্লাস হারমোনিকা এবং 'ফ্র্যাঙ্কলিন স্টোভ'ও তৈরি করেন। তিনি গাল্ফ স্ট্রিমের স্রোত অধ্যয়ন করেন এবং তার মানচিত্র তৈরি করেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমেরিকার জ্ঞানালোক (Enlightenment) যুগের ভিত্তি স্থাপন করে।

সমাজসেবা ও শিক্ষার আলো

ফ্র্যাঙ্কলিন বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষা ও জ্ঞান সমাজের মেরুদণ্ড। তিনি ১৭১১ সালে আমেরিকার প্রথম সর্বজনীন পাঠাগার 'লাইব্রেরি কোম্পানি অফ ফিলাডেলফিয়া' প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৫১ সালে 'পেন্সিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজ আমেরিকার অন্যতম प्रतिष्ठित প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য হয়। তিনি অগ্নিনির্বাপণ সেবা, হাসপাতাল এবং ডাক পরিষেবা-এর মতো প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি স্থাপনকারী প্রথম দিকের মানুষ ছিলেন। তিনি আমেরিকার প্রথম পোস্টমাস্টার জেনারেলও হয়েছিলেন।

রাজনীতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান

বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন কেবল বিজ্ঞানী ছিলেন না, আমেরিকার স্বাধীনতার লড়াইয়েও তিনি অগ্রণী ছিলেন। তিনি 'স্ট্যাম্প অ্যাক্ট'-এর বিরোধিতায় ব্রিটিশ সংসদে গিয়ে আমেরিকার আওয়াজ তুলে ধরেছিলেন। স্বাধীনতার ঘোষণা (Declaration of Independence), প্যারিস চুক্তি (যার মাধ্যমে আমেরিকার স্বাধীনতা স্বীকৃতি লাভ করে) এবং মার্কিন সংবিধান তিনটি নথিতেই স্বাক্ষরকারী তিনি ছিলেন একমাত্র প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ফ্রান্সে আমেরিকার প্রথম রাষ্ট্রদূত হন এবং আমেরিকা-ফ্রান্সের বন্ধুত্বকে আরও শক্তিশালী করেন।

মানবিক দিক এবং অন্তর্দ্বন্দ্ব

ফ্র্যাঙ্কলিনের জীবন কেবল সাফল্যে ভরা ছিল না, এতে মানবিক ত্রুটি এবং আত্ম-সংশোধনও ছিল। প্রথমে তিনি দাস প্রথার সমর্থন করেছিলেন, কিন্তু পরে তিনি এটিকে 'অনৈতিক' আখ্যা দিয়ে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন। তিনি সবসময় আত্ম-সমীক্ষণকে গুরুত্ব দিতেন এবং নৈতিকতার নীতিমালা তৈরি করেছিলেন, যা তিনি জীবনভর অনুসরণ করেছেন।

উত্তরাধিকার ও অনুপ্রেরণা: ফ্র্যাঙ্কলিনের অমর প্রভাব

বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের উত্তরাধিকার আজও জীবিত। তিনি আমেরিকার ১০০ ডলারের নোটে চিত্রিত আছেন এবং অনেক প্রতিষ্ঠান, জাহাজ, শহর, বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর নামে উৎসর্গীকৃত। তিনি যে মূল্যবোধগুলো দিয়েছেন—স্বাধীনতা, শিক্ষা, আবিষ্কার, সংলাপ এবং নৈতিকতা—সেগুলো আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছিলেন, 'Well done is better than well said.' অর্থাৎ, ভালো কাজ, ভালো কথা থেকে উত্তম। তাঁর জীবন এই নীতির প্রমাণ।

বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের জীবন আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, যদি উদ্দেশ্য শক্তিশালী হয়, তাহলে জ্ঞান, কঠোর পরিশ্রম এবং সেবার মাধ্যমে আমরা কেবল নিজেকে নয়, পুরো সমাজকে উন্নত করতে পারি। তিনি ছিলেন একজন যুগস্রষ্টা, যিনি বিজ্ঞানকে মানব সেবার সাথে যুক্ত করেছিলেন এবং স্বাধীনতাকে যুক্ত করেছিলেন বিবেকের সাথে। ভারত হোক বা আমেরিকা, প্রতিটি যুবকের তাঁর জীবন থেকে এই অনুপ্রেরণা নেওয়া উচিত যে জ্ঞানের আলো দিয়ে অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করা যায়।

Leave a comment