অবশেষে বিদায় মিগ-২১: ভারতীয় বিমান বাহিনীতে তেজসের নতুন যাত্রা

অবশেষে বিদায় মিগ-২১: ভারতীয় বিমান বাহিনীতে তেজসের নতুন যাত্রা

ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রথম সুপারসনিক ফাইটার জেট মিগ-২১ অবশেষে অবসর নিতে চলেছে। ৬২ বছরের সেবার পর এর জায়গা নেবে তেজস Mk1A।

MIG-21 Retirement: ভারতীয় বিমান বাহিনীর সবচেয়ে পুরনো ফাইটার জেট মিগ-২১ এখন চিরতরে অবসর নিতে যাচ্ছে। ১৯শে সেপ্টেম্বর চণ্ডীগড় এয়ারবেসে শেষবারের মতো মিগ-২১ উড়বে। এরপর এটিকে ভারতীয় বিমান বাহিনী থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর দেওয়া হবে। এই যুদ্ধবিমান ১৯৬৩ সাল থেকে ভারতীয় বিমান বাহিনীর অংশ ছিল এবং এখন এর জায়গায় দেশীয় ফাইটার জেট তেজস Mk1A আসবে।

মিগ-২১ এর ভারতীয় বিমান বাহিনীতে প্রবেশ

মিগ-২১ সোভিয়েত ইউনিয়নে তৈরি সুপারসনিক ফাইটার জেট। ১৯৬৩ সালে ভারত এটিকে পরীক্ষামূলকভাবে বিমান বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে। সেই সময় এটি ছিল ভারতের প্রথম সুপারসনিক ফাইটার জেট, যা শব্দের থেকেও দ্রুত গতিতে উড়তে পারত। ধীরে ধীরে এটি বিমান বাহিনীর মেরুদণ্ড হয়ে ওঠে। ভারত মিগ-২১ এর বিভিন্ন সংস্করণ যেমন টাইপ-৭৭, টাইপ-৯৬, বিআইএস এবং বাইসন কিনেছিল। সব মিলিয়ে ৯০০টির বেশি মিগ-২১ ভারতীয় বিমান বাহিনীর বহরে যুক্ত করা হয়েছিল, যার মধ্যে ৬৬০টি এইচএএল দেশেই তৈরি করেছিল।

গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলিতে মিগ-২১ এর ভূমিকা

১৯৬৫ সালের ভারত-পাক যুদ্ধে মিগ-২১ প্রথমবার যুদ্ধক্ষেত্রে অংশ নেয়। এটি পাকিস্তানি ফাইটার জেটগুলোকে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেয়। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে মিগ-২১ পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) কে স্বাধীন করতে বড় ভূমিকা পালন করে।

১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধে মিগ-২১ রাতে উড়ে গিয়ে শত্রুর অবস্থান চিহ্নিত করে এবং সাধারণ জিপিএস ও স্টপওয়াচের সাহায্যে হামলা চালায়। ২০১৯ সালের বালাকোট স্ট্রাইকের পর পাকিস্তানের এফ-১৬ বিমানকে ভূপাতিত করার কৃতিত্বও মিগ-২১ বাইসন এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন অভিনন্দন বর্তমানের।

মিগ-২১ এর শক্তি এবং অস্ত্র ব্যবস্থা

মিগ-২১ এ চারটি হার্ডপয়েন্ট রয়েছে। এতে R-60 এবং R-73 এর মতো এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল লাগানো যেতে পারে। এই ফাইটার জেট শত্রুর বিমানকে আকাশে আটকে দিতে পারে। যদিও এর প্রযুক্তি রাফাল বা Su-30MKI এর মতো আধুনিক নয়। এর রাডার সিস্টেম এবং ডেটা প্রসেসিং সীমিত। তবুও এটি শত্রুর জন্য বড় বিপদ ছিল।

বাইসন সংস্করণ কী ছিল

মিগ-২১ কে ভারতে আপগ্রেড করে মিগ-২১ বাইসনে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। এতে আধুনিক রাডার, GPS, কমিউনিকেশন সিস্টেম, হেলমেট মাউন্টেড সাইটস এবং মিসাইল সিস্টেম যোগ করা হয়েছিল। এই সংস্করণটি গত দুই দশক ধরে পরিষেবা দিয়েছে। কিন্তু এর পুরনো কাঠামো এবং ডিজাইনের সীমাবদ্ধতা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।

'উড়ন্ত কফিন' নাম কিভাবে পড়ল

যদিও মিগ-২১ অনেক যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, কিন্তু ক্রমাগত দুর্ঘটনার কারণে এর ভাবমূর্তি খারাপ হয়েছে। গত ৬০ বছরে ৫০০টির বেশি মিগ-২১ ভেঙে পড়েছে। এতে ২০০ জনের বেশি বিমান বাহিনীর পাইলট এবং ৬০ জন সাধারণ নাগরিকের প্রাণ গেছে। তাই একে 'উড়ন্ত কফিন' এবং 'বিধবা প্রস্তুতকারক' বলা হত।

এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ ছিল। প্রথমত, এর পুরনো ডিজাইন, যা আজকের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী বাতিল হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, রক্ষণাবেক্ষণে সমস্যা এবং তৃতীয়ত, কখনও কখনও পাইলটদের ভুল বা প্রশিক্ষণের অভাব।

তেজস কেন সময় মতো এল না

মিগ-২১ কে সরানোর পরিকল্পনা ২০২২ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তেজসের ডেলিভারিতে দেরি হওয়ার কারণে এটা সম্ভব হয়নি। তেজস Mk1A এর জন্য প্রয়োজনীয় GE-F404 ইঞ্জিন আমেরিকার থেকে আসার কথা ছিল। সাপ্লাই চেইনে সমস্যার কারণে এটি মার্চ ২০২৫ এ শুরু হতে পেরেছে। এখনও পর্যন্ত মাত্র দুটি ইঞ্জিন ভারতে এসেছে। মার্চ ২০২৬ এর মধ্যে প্রতি মাসে দুটি ইঞ্জিন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এছাড়াও তেজস Mk1A তে যে নতুন সিস্টেম যেমন AESA রাডার, ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম ইত্যাদি যোগ করা হয়েছে, সেগুলোর টেস্টিং এবং সার্টিফিকেশনেও সময় লেগেছে। HAL বেঙ্গালুরু এবং নাসিকে তেজসের প্রোডাকশনের জন্য দুটি লাইন শুরু করেছে।

তেজস নেবে মিগ-২১ এর জায়গা

এখন মিগ-২১ এর জায়গায় স্বদেশী তেজস Mk1A আসবে। HAL এবং ADA দ্বারা ডিজাইন এবং নির্মিত তেজসকে ভারতীয় বিমান বাহিনীর জন্য ২২০ ইউনিট পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই নতুন বিমান শুধুমাত্র মিগ-২১ থেকে বেশি নিরাপদ এবং সক্ষম নয়, বরং আধুনিক যুদ্ধের প্রযুক্তির জন্যেও আরও উন্নত।

মিগ-২১ এর শেষ কোথায় মোতায়েন ছিল

বর্তমানে মিগ-২১ এর কেবল ৩৬টি ফাইটার ভারতীয় বিমান বাহিনীর বহরে অবশিষ্ট আছে। এগুলো রাজস্থানের বিকানের এবং সুরাটগড়ে মোতায়েন রয়েছে। এদের কোবরা (নম্বর-৩ স্কোয়াড্রন) এবং প্যান্থার্স (নম্বর-২৩ স্কোয়াড্রন) বলা হয়। চণ্ডীগড় এয়ারবেসে ১৯শে সেপ্টেম্বর শেষ উড়ানের সাথে মিগ-২১ এর আনুষ্ঠানিক অবসর অনুষ্ঠান হবে।

2021 সালের পর মিগ-২১ দুর্ঘটনা

৫ জানুয়ারি ২০২১: সুরাটগড়, পাইলট সুরক্ষিত
১৭ মার্চ ২০২১: গোয়ালিয়র, গ্রুপ ক্যাপ্টেন শহীদ
২০ মে ২০২১: মোगा, পাইলটের মৃত্যু
২৫ আগস্ট ২০২১: বারমের, পাইলট সুরক্ষিত
২৫ ডিসেম্বর ২০২১: বারমের, উইং কমান্ডার হর্ষিত সিনহা की मौत
২৮ জুলাই ২০২২: বারমের, দুই পাইলটের মৃত্যু
৮ মে ২০২৩: হনুমানগড়, পাইলট সুরক্ষিত, নাগরিকদের মৃত্যু

Leave a comment