ভারত-চীন বৈঠকে রেয়ার-আর্থ ম্যাগনেট নিয়ে আলোচনা: শিল্পমহলে নতুন আশা

ভারত-চীন বৈঠকে রেয়ার-আর্থ ম্যাগনেট নিয়ে আলোচনা: শিল্পমহলে নতুন আশা

ভারত ও চীনের মধ্যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠকে রেয়ার-আর্থ ম্যাগনেটের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলির বিষয়টি বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। ১৪ জুন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর এবং চীনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই-র মধ্যে অনুষ্ঠিত এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে রেয়ার-আর্থ মেটালস-এর আমদানি নিয়ে ইতিবাচক আবহাওয়া তৈরি হয়েছে, যা ভারতীয় ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে নতুন আশা জাগিয়েছে।

বৈঠকের পর সূত্রের খবর অনুযায়ী, উভয় দেশ বাণিজ্যিক বিষয় নিয়ে গঠনমূলক আলোচনার ওপর জোর দিয়েছে এবং রেয়ার-আর্থ ম্যাগনেটের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে সহযোগিতা বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে। ভারতীয় শিল্পমহল আশা করছে যে আগামী দিনে চীন এই নিষেধাজ্ঞাগুলিতে কিছু শিথিলতা দেখাতে পারে, যা বিশেষ করে ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইল এবং গ্রিন এনার্জি সম্পর্কিত কোম্পানিগুলির জন্য বড় স্বস্তি নিয়ে আসবে।

ভারতীয় শিল্পের উপর প্রভাব

চীনের বর্তমান নীতির কারণে রেয়ার-আর্থ ম্যাগনেট আমদানি করা ভারতীয় কোম্পানিগুলোর জন্য ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ইলেকট্রিক ভেহিকেল প্রস্তুতকারক, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক সংস্থা এবং মেডিকেল ডিভাইস সেক্টর এই সরবরাহ সংকটের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।

শিল্প সংগঠন ফিকি এবং সিআইআই-এর মতো সংস্থাগুলি সরকারের কাছে ক্রমাগত দাবি জানিয়েছিল যে চীনের সঙ্গে আলোচনায় রেয়ার-আর্থ সম্পর্কিত বিষয়গুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হোক। এখন যখন বিদেশমন্ত্রী স্বয়ং এই বিষয়টি চীনের সামনে রেখেছেন, তখন শিল্পমহলে একটি নতুন উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে।

রেয়ার-আর্থ ম্যাগনেটের গুরুত্ব কী

রেয়ার-আর্থ ম্যাগনেট অর্থাৎ দুর্লভ মৃত্তিকা চুম্বক প্রযুক্তি ক্ষেত্রের অনেক প্রধান সরঞ্জামে ব্যবহৃত হয়। এই ম্যাগনেটগুলি ইলেকট্রিক ভেহিকেল, উইন্ড টারবাইন, মোবাইল ডিভাইস, মেডিকেল স্ক্যানার এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের মতো উন্নত পণ্যের আত্মা হিসাবে বিবেচিত হয়। এর শক্তি এবং স্থায়িত্ব এটিকে বিশেষ করে তোলে।

ভারত এখনও পর্যন্ত রেয়ার-আর্থ ম্যাগনেটের জন্য চীনের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। বিশ্বজুড়ে রেয়ার-আর্থ উপাদানের সাপ্লাই চেইনের প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ চীনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে চীন কর্তৃক এর ওপর যে কোনও ধরনের এক্সপোর্ট নিষেধাজ্ঞা বা নিয়ন্ত্রণ ভারত-এর মতো উদীয়মান প্রযুক্তি দেশগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে।

চীন রেয়ার-আর্থের উপর কেন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল

গত কয়েক বছরে চীন রেয়ার-আর্থ উপাদানের রপ্তানির উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর কারণ ছিল অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি এবং পরিবেশগত প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা। এছাড়াও কিছু আন্তর্জাতিক উত্তেজনার কারণে চীন কৌশলগতভাবে রেয়ার-আর্থের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে।

চীনের যুক্তি ছিল যে এই সম্পদ সীমিত এবং এর পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব রয়েছে, তাই এর ব্যবহার এবং রপ্তানি উভয় ক্ষেত্রেই সতর্কতার সঙ্গে কাজ করা জরুরি। তবে এর ফলে ভারত সহ অনেক উন্নয়নশীল দেশের শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ভারতে রেয়ার-আর্থের উৎপাদন ও বিকল্প

ভারতে রেয়ার-আর্থ উপাদানের ভাণ্ডার রয়েছে, বিশেষ করে ওড়িশা, অন্ধ্র প্রদেশ, ঝাড়খণ্ড এবং কেরালার মতো রাজ্যগুলিতে। কিন্তু এর বাণিজ্যিক ব্যবহার এখনও সীমিত। এর পিছনে প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ, বিনিয়োগের অভাব এবং পরিবেশগত ছাড়পত্রের মতো বাধা রয়েছে।

ভারত সরকারও এই দিকে পদক্ষেপ নিয়ে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে রেয়ার-আর্থ খনি এবং প্রক্রিয়াকরণের অনুমতি দেওয়ার পরিকল্পনা শুরু করেছে। এর পাশাপাশি ভারতীয় কোম্পানিগুলো জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকার মতো দেশের সঙ্গে সাপ্লাই চুক্তিও করছে।

প্রযুক্তি ক্ষেত্রে স্বস্তির আশা

প্রযুক্তি এবং স্টার্টআপ সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত উদ্যোক্তাদের বিশ্বাস, রেয়ার-আর্থ ম্যাগনেটের সহজলভ্যতা ভারতকে গ্রিন টেকনোলজি, সেমিকন্ডাক্টর নির্মাণ এবং হাই এন্ড মেকানিক্যাল সরঞ্জাম নির্মাণে স্বয়ংনির্ভর করার দিকে একটি বড় পদক্ষেপ হবে।

চীনের সঙ্গে সহযোগিতা হলে শুধু খরচ কমবে তাই নয়, পণ্যের গুণগত মান এবং বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতাও উন্নত হবে। পাশাপাশি ভারতের পিএলআই স্কিমের (উৎপাদন ভিত্তিক प्रोत्साहन योजना) অধীনে কোম্পানিগুলো আরও শক্তিশালী হবে।

আলোচনা থেকে কারা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে

যদি চীন রেয়ার-আর্থ ম্যাগনেটের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করে, তবে ভারতের অনেক উদীয়মান শিল্প সরাসরি উপকৃত হবে। বিশেষ করে EV স্টার্টআপ, স্মার্টফোন কোম্পানি, প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত পাবলিক সেক্টর ইউনিট এবং মেডিকেল ডিভাইস প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি উল্লেখযোগ্যভাবে লাভবান হতে পারে।

এছাড়াও এই পদক্ষেপ ভারত-চীন বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্বাস পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত হিসাবে বিবেচিত হবে। গত কয়েক বছরে সীমান্ত বিরোধের কারণে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সহযোগিতায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছিল, তবে এখন প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন করে আলোচনার সূচনা হচ্ছে।

বিদেশ মন্ত্রকের সতর্কতায় বাড়ল ভরসা

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত সরকারের এই উদ্যোগ প্রমাণ করে যে এখন বিদেশ নীতি কেবল কূটনৈতিক উদ্দেশ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ও শিল্প কৌশলকেও শক্তিশালী করা হচ্ছে।

ভারত-চীন আলোচনায় রেয়ার-আর্থের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়ার মাধ্যমে এই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে এখন থেকে প্রতিটি আলোচনায় শিল্পের স্বার্থকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হবে। এর ফলে ভারতীয় বাণিজ্যিক মহল এবং বিশ্ব বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভারতের প্রতি আস্থা আরও বাড়তে পারে।

Leave a comment