বর্ষাকালের মনোরম আবহাওয়া যেমন মনকে শান্তি দেয়, তেমনই এটি শরীরের জন্য গুরুতর রোগের কারণও হতে পারে। বৃষ্টির দিনগুলোতে আর্দ্রতা, ময়লা এবং দূষিত পানির কারণে শরীরের অভ্যন্তরে বিষাক্ত পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যায়। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে কিডনি এবং মূত্রতন্ত্রের উপর। এই সময়ে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, ব্লকেজ এবং ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বৃদ্ধি একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কেন বর্ষাকালে ইউরিক অ্যাসিড বাড়ে?
ইউরিক অ্যাসিড শরীরে বিদ্যমান পিউরিন নামক একটি উপাদানের ভাঙ্গন থেকে তৈরি হয়। যখন এই অ্যাসিড প্রয়োজনের চেয়ে বেশি তৈরি হতে শুরু করে বা শরীর এটিকে বাইরে বের করতে পারে না, তখন এটি বিপজ্জনক রূপ ধারণ করে। বর্ষাকালে কম ঘাম হওয়া, দূষিত জল পান করা এবং ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধির প্রধান কারণ। এছাড়াও, এই সময়ে ভাইরাল জ্বর এবং ঔষধ সেবনের কারণেও কিডনির উপর প্রভাব পড়ে।
ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধির লক্ষণ
- জয়েন্টগুলোতে জ্বালাপোড়া এবং তীব্র ব্যথা
- পা ও গোড়ালিতে ফোলাভাব
- আঙুলে সুচ ফোটানোর মতো ব্যথা
- প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া এবং বাধা
- অবিরাম ক্লান্তি এবং ভারী ভাব
সময় থাকতে এই লক্ষণগুলো উপেক্ষা করলে এটি উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক এবং কিডনি ফেইলিউরের মতো গুরুতর রোগের রূপ নিতে পারে।
ICMR এবং AIIMS-এর রিপোর্ট কী বলছে?
ভারতীয় চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ (ICMR) এবং এমস (AIIMS)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI) এবং প্রোস্টেট সমস্যার ঘটনায় ২৫-৩৫% পর্যন্ত বৃদ্ধি দেখা যায়। বিশেষ করে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত বয়স্ক ব্যক্তি, মহিলা এবং দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা এই ঝুঁকির শিকার হন।
স্বামী রামদেবের আয়ুর্বেদিক প্রতিকার
স্বামী রামদেবের মতে, শরীরকে প্রাকৃতিক উপায়ে ভারসাম্যপূর্ণ করাই আসল সমাধান। তিনি বর্ষাকালে কিছু সহজ ও কার্যকরী আয়ুর্বেদিক প্রতিকারের কথা বলেন:
১. নিম পাতার রস (সকালে খালি পেটে): ১ চামচ নিম পাতার রস পান করলে শরীরের বিষাক্ত পদার্থ বের হয়ে যায়। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা স্থিতিশীল রাখে।
২. পিপুল গাছের রস (সন্ধ্যায়): ১ চামচ পিপুলের তাজা পাতার রস কিডনির কার্যকারিতা বাড়ায় এবং ফোলাভাব কমায়।
৩. গোখরুর জল: গোখরুকে জলে ফুটিয়ে ঠান্ডা করে দিনে দুবার পান করুন। এটি ইউরিক অ্যাসিড, কিডনি স্টোন এবং প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া থেকে মুক্তি দেয়।
৪. পাথরকুচি পাতা: এটি কিডনি স্টোনের চিকিৎসায় খুব উপকারী হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি চিবিয়ে খাওয়া বা কাড়া তৈরি করে পান করলে উপকার পাওয়া যায়।
ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধি করে এমন খাবার থেকে দূরে থাকুন
স্বামী রামদেব-এর মতে, কিছু খাবার বর্ষাকালে ইউরিক অ্যাসিড আরও বাড়িয়ে দেয়, যেমন:
- পনির, দুধ এবং অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্য
- অড়হর ও ছোলা জাতীয় ডাল
- টমেটো, বেগুন এবং ফুলকপি
- অতিরিক্ত চিনি ও নুন
- মদ ও সিগারেট
- ফাস্ট ফুড ও ভাজাভুজি
ইউরিক অ্যাসিড কমানোর ঘরোয়া খাবার
- কুলথ ডাল – সহজে হজমযোগ্য এবং ইউরিক অ্যাসিড কমায়।
- মুলা এবং তার রস – কিডনি পরিষ্কার রাখে এবং ফোলাভাব দূর করে।
- টক দই – হজমক্ষমতা উন্নত করে এবং শরীরকে শীতল রাখে।
- যবের ছাতু – শরীরকে ডিটক্স করে এবং শক্তি যোগায়।
- ভূট্টার শস্যের জলের বালিশ – কিডনি স্টোন ও ইউরিক অ্যাসিড উভয় ক্ষেত্রেই উপকারী।
যোগ ও প্রাণায়াম থেকে মিলবে স্বস্তি
স্বামী রামদেব দ্বারা নির্দেশিত আসন ও প্রাণায়াম ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে সহায়ক:
- বজ্রাসন – হজমক্ষমতা বাড়ায় ও অ্যাসিড কমায়
- পবনমুক্তাসন – গ্যাস ও ইউরিক অ্যাসিডের শত্রু
- কপালভাতি – শরীরকে ডিটক্স করার সহজ উপায়
- অনুলেম-বিলেম – শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখার অভ্যাস
সতর্কতাই সবচেয়ে বড় চিকিৎসা
বর্ষাকালে সংক্রমণ ও ইউরিক অ্যাসিডের সমস্যা থেকে বাঁচতে প্রয়োজন:
- পরিষ্কার জল পান করুন
- তাজা ও সেদ্ধ খাবার খান
- সময়মতো প্রস্রাব ত্যাগ করুন
- শরীরে জলের অভাব হতে দেবেন না
- নিয়মিত ব্যায়াম ও যোগাভ্যাস করুন
বর্ষাকাল যেমন সুন্দর, তেমনই বিপজ্জনকও। এই সময়ে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যেমন কিডনি ও লিভারের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। স্বামী রামদেবের দেওয়া সহজ ঘরোয়া উপায়গুলি অবলম্বন করে শুধু ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, বরং কিডনিকে দীর্ঘকাল সুস্থ রাখা যায়।