চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী: স্বাধীনতা সংগ্রামী, রাজনীতিবিদ ও নৈতিকতার প্রতীক

চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী: স্বাধীনতা সংগ্রামী, রাজনীতিবিদ ও নৈতিকতার প্রতীক

ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অনেক মহান নেতা তাঁদের অবদান রেখেছেন, কিন্তু এমন কিছু ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যাঁদের গভীরতা এবং দূরদৃষ্টি আজও সমাজের প্রতিটি কোণে অনুপ্রেরণা যোগায়। চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী, যিনি সাধারণত 'রাজাজী' নামে পরিচিত, সেই মহান ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি কেবল স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিক ছিলেন না, বরং ভারতের শেষ গভর্নর-জেনারেল, প্রখর লেখক, সমাজ সংস্কারক, চিন্তাশীল রাজনীতিবিদ এবং নৈতিকতার এক অনন্য প্রতীকও ছিলেন। তাঁর জীবনযাত্রা এমন এক দেশপ্রেমিকের গল্প, যিনি ক্ষমতার চেয়ে নীতিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং সবসময় দেশ-এর স্বার্থে নির্ভীকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

প্রারম্ভিক জীবন: গ্রাম থেকে গৌরবের কাহিনী

রাজাগোপালাচারীর জন্ম ১০ ডিসেম্বর ১৮৭৮ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির থোরাপল্লী নামক গ্রামে, যা বর্তমানে তামিলনাড়ুর কৃষ্ণগিরি জেলায় অবস্থিত। তিনি ছিলেন বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। ছোটবেলায় তিনি দুর্বল এবং প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন, কিন্তু তাঁর মধ্যে এক অসাধারণ প্রতিভা ছিল। শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি ব্যাঙ্গালোরের সেন্ট্রাল কলেজ এবং মাদ্রাজ-এর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। ১৮৯৭ সালে তিনি আইনের ডিগ্রি লাভ করেন এবং সালেমে প্র্যাকটিস শুরু করেন। তাঁর বৈবাহিক জীবনও সামাজিক প্রথা অনুযায়ী খুব দ্রুত শুরু হয়েছিল। তিনি আলামেলু মঙ্গাম্মা-কে বিবাহ করেন, যাঁর গর্ভে তাঁর পাঁচটি সন্তান জন্মায়। স্ত্রীর অকাল মৃত্যুর পর তিনি একাই তাঁর সন্তানদের লালন-পালন করেন, যা তাঁর পারিবারিক দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়।

স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম সারির নেতৃত্ব

রাজাগোপালাচারী ১৯০৬ সালে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে যোগ দিয়ে রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয় হন। মহাত্মা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে তিনি অসহযোগ আন্দোলন, লবণ সত্যাগ্রহ এবং ভাইকম সত্যাগ্রহে অংশ নেন। গান্ধীজি তাঁকে 'আমার অন্তরাত্মার রক্ষক' বলেছিলেন — এই উপাধি তাঁর নৈতিক চরিত্র এবং প্রকৃত নেতৃত্বের প্রমাণ দেয়। ১৯৩০ সালে তিনি ডান্ডি মার্চের জবাবে ভedaranyam লবণ সত্যাগ্রহের নেতৃত্ব দেন, যেখানে তাঁকে কারারুদ্ধও করা হয়েছিল। তিনি ছিলেন এমন একজন নেতা যিনি সহিংসতা ছাড়াই পরিবর্তন আনতে বিশ্বাস করতেন এবং অহিংসাকে তাঁর জীবনের মূল মন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

রাজনৈতিক জীবন এবং বিতর্কিত সিদ্ধান্ত

রাজাগোপালাচারী ১৯৩৭ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হন। তাঁর দ্বারা প্রবর্তিত মদ্যপান নিষিদ্ধকরণ এবং কৃষি ঋণ ত্রাণ-এর মতো সিদ্ধান্তগুলি জনগণের স্বার্থে ছিল। কিন্তু হিন্দি ভাষা বাধ্যতামূলক করা এবং প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্প-এর মতো কিছু সিদ্ধান্তের কারণে তাঁকে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। অনেক বিরোধী একে 'জাতিবাদী শিক্ষানীতি' বলে নিন্দা করেন। ১৯৪০ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করেন। তাঁর এই পদক্ষেপকে সেই সময়ে অনেকেই জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী বলে মনে করেছিলেন, কিন্তু রাজাজীর ধারণা ছিল, এটি ছিল আলোচনার এবং কৌশলের সময়, সংগ্রামের নয়। তিনি মুসলিম লীগ এবং মহম্মদ আলি জিন্নাহর সঙ্গে আলোচনার সমর্থন করেন এবং বিভাজনের সমাধানের জন্য 'সিআর ফর্মুলা' পেশ করেন, যা রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচিত হয়।

স্বাধীন ভারতের প্রথম এবং শেষ ভারতীয় গভর্নর-জেনারেল

ভারত স্বাধীন হওয়ার পর, যখন লর্ড মাউন্টব্যাটনের মেয়াদ শেষ হয়, তখন রাজাগোপালাচারীকে ভারতের গভর্নর-জেনারেল নিযুক্ত করা হয়। তিনি এই পদে আসীন হওয়া প্রথম এবং একমাত্র ভারতীয় ছিলেন। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যখন ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ভারতের সর্বোচ্চ পদটি একজন ভারতীয়র হাতে অর্পণ করা হয়েছিল। গভর্নর-জেনারেল হিসেবে তিনি সাদাসিধে জীবন এবং নৈতিকতার আদর্শ স্থাপন করেন। তিনি কলকাতা দাঙ্গার পর পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিসেবেও শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন পার্টির প্রতিষ্ঠা: গান্ধীবাদের ধারণার রাজনৈতিক পুনরব্যাখ্যা

১৯৫১ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পরে মাদ্রাজ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও ছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস পার্টির নীতিতে অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি ১৯৫৯ সালে পদত্যাগ করেন এবং 'স্বাধীন পার্টি' প্রতিষ্ঠা করেন। এই পার্টি ভারতে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনকারী প্রথম শক্তিশালী দল হয়ে ওঠে, যা ১৯৬২, ১৯৬৭ এবং ১৯৭১ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। রাজাজী এই পার্টির মাধ্যমে গান্ধীবাদের নতুন ব্যাখ্যা করেন এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা ও ন্যূনতম সরকারের পক্ষে সওয়াল করেন।

সমাজ সংস্কারক এবং লেখক: আত্মার স্পর্শ করা লেখনী

রাজাগোপালাচারী একজন দক্ষ লেখকও ছিলেন। তিনি 'রামায়ণ', 'মহাভারত' এবং 'ভগবদ্গীতা'-র মতো গ্রন্থগুলির সহজ ইংরেজি অনুবাদ করেন, যা আজও লক্ষ লক্ষ পাঠককে আকৃষ্ট করে। তাঁর লেখা সমাজকে দিশা দিত, নৈতিকতা পরিপূর্ণ ছিল এবং ভাষাগত সৌন্দর্যে ভরপুর ছিল। তিনি 'কুরেই ওনরুম ইল্লাই' নামক বিখ্যাত ভক্তিগীতিরও রচনা করেন, যা আজও তামিলনাড়ুর মন্দিরগুলিতে গাওয়া হয়। তিনি বাল্যবিবাহ, অস্পৃশ্যতা এবং মদ্যপানের মতো সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এবং দলিতদের মন্দির প্রবেশ আন্দোলনের সমর্থন করেছিলেন।

শেষ জীবনের সাদাসিধে জীবন এবং প্রয়াণ

নিজের শেষ বছরগুলিতে তিনি রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান, তবে সামাজিক চিন্তাভাবনায় মগ্ন ছিলেন। ২৫ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে ৯৪ বছর বয়সে তিনি এই পৃথিবী ত্যাগ করেন। তাঁর শেষকৃত্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়েছিল, যা একজন প্রকৃত দেশ সেবককে দেওয়া শ্রদ্ধাঞ্জলি ছিল।

চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারীর জীবন ভারতীয় রাজনীতি, নৈতিকতা এবং সমাজ সংস্কারের একটি অনুপ্রেরণামূলক অধ্যায়। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে স্বাধীন ভারত গঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর চিন্তা, নেতৃত্ব এবং নীতি আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। আমাদের তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে সত্য, ন্যায়পরায়ণতা এবং জনসেবার পথে চলতে হবে, যাতে আমরা একটি শক্তিশালী এবং সমন্বিত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারি।

Leave a comment