নির্বাচন কমিশনের দেশজুড়ে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনের প্রস্তুতি

নির্বাচন কমিশনের দেশজুড়ে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনের প্রস্তুতি

নির্বাচন কমিশন আজ সকল রাজ্যের মুখ্য নির্বাচন আধিকারিকদের সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করবে। এতে ভোটার তালিকার গভীর পর্যালোচনার (SIR) রূপরেখা স্থির হবে। ২০০৩ সালের পর প্রথমবার সারা দেশে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন (Intensive Revision) করা হবে।

New Delhi: আসন্ন বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচন সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে পরিচালনা করার জন্য নির্বাচন কমিশন (Election Commission of India) এক বড় প্রস্তুতি শুরু করেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) কমিশন সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মুখ্য নির্বাচন আধিকারিকদের (CEO) এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ডেকেছে। এই বৈঠকে দেশজুড়ে ভোটার তালিকার গভীর পর্যালোচনা অর্থাৎ Summary Intensive Revision (SIR) শুরু করার রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে।

এই বৈঠকের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র ভোটার তালিকার সংশোধন করাই নয়, বরং নির্বাচন প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য করে তোলাও। এতে আচরণবিধি (Model Code of Conduct) থেকে শুরু করে প্রযুক্তিগত সংস্কার এবং ভোটার তালিকায় স্বচ্ছতা আনার মতো বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে।

ভোটার তালিকা পর্যালোচনা কেন জরুরি

ভারতে প্রতি বছর ভোটার তালিকায় (Voter List) নিয়মিত সংশোধন করা হয়, কিন্তু ২০০৩ সালের পর থেকে নিবিড় পর্যালোচনা (Intensive Revision) করা হয়নি। নগরায়ণ এবং ব্যাপক হারে দেশত্যাগের কারণে ভোটার তালিকায় ডুপ্লিকেট নাম এবং ভুল তথ্য অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে গেছে। এই কারণেই কমিশন এবার একটি ব্যাপক এবং গুরুতর যাচাইকরণ প্রক্রিয়া শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এই প্রক্রিয়ার অধীনে প্রতিটি ভোটারের নাম, ঠিকানা এবং যোগ্যতার নথি পুনরায় পরীক্ষা করা হবে। এর ফলে নিশ্চিত করা যাবে যে, ভোটার তালিকা থেকে জাল নাম বাদ যাবে এবং কোনো যোগ্য ভোটার বাদ পড়বে না।

বিহার হলো মডেল

বিহারের সম্প্রতি বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়েছিল। সেখানে নতুন গণনা ফর্ম (enumeration form) এবং ১১ ধরনের নথির তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। সকল বর্তমান ভোটারদের জন্য ফর্ম পূরণ করা বাধ্যতামূলক ছিল। অন্যদিকে, ২০০৩ সালের পর যে নামগুলি যুক্ত হয়েছিল, তাদের জন্য যোগ্যতার নথি জমা দেওয়া জরুরি করা হয়েছিল।

এই দীর্ঘ প্রক্রিয়াটি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে এবং ৩০ সেপ্টেম্বর বিহারের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশিত হবে। বিহারের এই মডেল এখন দেশজুড়ে অন্যান্য রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির জন্য ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।

জুন মাসে নির্দেশিকা জারি হয়েছিল

নির্বাচন কমিশন জুন মাসেই সকল রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের CEO-দের এই প্রক্রিয়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। বুধবারের বৈঠকটি এই প্রস্তুতির একটি পর্যালোচনা।

বৈঠকের সভাপতিত্ব করবেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার (CEC) জ্ঞানেশ কুমার। এতে CEO-দের নিজ নিজ রাজ্যের প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। প্রতিবেদনে ভোটার সংখ্যা, পূর্ববর্তী পর্যালোচনার বিবরণ এবং বর্তমান সংশোধনের অবস্থা অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

বৈঠকে কী থাকবে আলোচ্যসূচি

দিল্লির দ্বারকায় অবস্থিত ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকশন ম্যানেজমেন্টে সকাল ১০টা থেকে এই বৈঠক শুরু হয়েছে। এই বৈঠকের আলোচ্যসূচি অত্যন্ত ব্যাপক। এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে—

  • ভোটার তালিকার নিবিড় পর্যালোচনা (SIR)
  • ডুপ্লিকেট এবং জাল নামের শনাক্তকরণ
  • আচরণবিধি (Model Code of Conduct) পালনের রূপরেখা
  • নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তিগত সংস্কার
  • স্বচ্ছতা ও নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করার উপায়

বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কোন কোন রাজ্যে কবে এবং কীভাবে SIR প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।

নির্বাচনের আগে এই পর্যালোচনা কেন গুরুত্বপূর্ণ

নির্বাচন গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎসব এবং এতে ভোটার তালিকার সঠিকতা অত্যন্ত জরুরি। যদি ভোটার তালিকা সঠিক না হয়, তবে অনেক যোগ্য ভোটার তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন এবং অনেক অযোগ্য ব্যক্তি ভোট দিতে পারবেন।

২০০৩ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত পরিস্থিতি দেখলে দেখা যাবে, দেশে ব্যাপক হারে দেশত্যাগ এবং নগরায়ণ হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ বা পড়াশোনার জন্য এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে গেছেন। এমন পরিস্থিতিতে তাদের নাম অনেক সময় পুরোনো ভোটার তালিকায় থেকে যায় এবং নতুন জায়গায়ও যুক্ত হয়ে যায়। এই ত্রুটি নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

আসন্ন নির্বাচনগুলিতে কী প্রভাব পড়বে

কমিশনের এই উদ্যোগের সরাসরি প্রভাব পড়বে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে। যে রাজ্যগুলিতে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে এই প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা হবে। এর মাধ্যমে নিশ্চিত করা হবে যে, নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকা সম্পূর্ণভাবে পরিচ্ছন্ন এবং আপডেট করা হয়েছে।

এবার কমিশনের চেষ্টা হল প্রযুক্তিগত মাধ্যমগুলির বেশি ব্যবহার করা। ডিজিটাল ফর্ম, অনলাইন ভেরিফিকেশন এবং আধার লিঙ্কিং-এর মতো প্রক্রিয়াগুলিও এতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

কমিশনের অগ্রাধিকার

নির্বাচন কমিশন বরাবরই দাবি করে এসেছে যে, তারা নিরপেক্ষ এবং নির্ভরযোগ্য নির্বাচন পরিচালনা করে। কিন্তু গত কয়েক বছরে বিরোধী দলগুলি ইভিএম থেকে শুরু করে ভোটার তালিকা পর্যন্ত অনেক বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাই কমিশন এবার কোনো ভুল করতে চায় না। SIR-এর মতো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটি প্রমাণ করার চেষ্টা হবে যে, নির্বাচন কমিশন স্বচ্ছতা ও সঠিকতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

জনগণের কাছেও আবেদন জানানো হবে

ভোটার তালিকার পর্যালোচনা শুধুমাত্র আধিকারিকদের দায়িত্ব নয়। এই প্রক্রিয়ায় জনগণকে যুক্ত করা হবে। প্রত্যেক ভোটার তাদের তথ্য যাচাই করার এবং কোনো ভুল থাকলে তা সংশোধনের সুযোগ পাবে। কমিশন এই প্রক্রিয়া নিয়ে একটি ব্যাপক সচেতনতা অভিযান চালাবে যাতে বেশি সংখ্যক মানুষ এতে অংশগ্রহণ করে।

Leave a comment