ঋণের চাপ, মাথার উপর শিয়রে খাঁড়া
আজকের দিনে ঋণ নেওয়া অনেকের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা। বাড়ি, গাড়ি কিংবা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে সহজেই লোন মিলছে, তবে সেই লোনের কিস্তি বা ইএমআই যেন প্রতিমাসেই দুশ্চিন্তার কারণ। চাকরি হঠাৎ চলে গেলে বা ব্যবসায় ক্ষতি হলে ইএমআই শোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এক মাসের কিস্তি মিস হলেই ডিফল্টারের তালিকায় নাম উঠতে পারে। এর ফলে ক্রেডিট স্কোরও নষ্ট হয়, ভবিষ্যতে নতুন ঋণ নেওয়ার পথ হয়ে যায় আরও কঠিন।
সমস্যার মাঝেই একটুখানি স্বস্তি—লোন মোরাটোরিয়াম
আর্থিক বিপদে পড়ে বহু মানুষই জানেন না যে কিছু ক্ষেত্রে ইএমআই সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা সম্ভব। এর নাম লোন মোরাটোরিয়াম। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঋণের কিস্তি স্থগিত রাখা। তবে এটা কোনও স্থায়ী সমাধান নয়, বরং অস্থায়ী স্বস্তি। চাকরি হারানো, প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিংবা মেডিক্যাল জরুরী অবস্থায় ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহককে এই সুবিধা দিয়ে থাকে।
লোন মোরাটোরিয়াম আসলে কী?
সহজ ভাষায় বললে, মোরাটোরিয়াম মানে কিছুদিনের জন্য ইএমআই দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি। এই সময়সীমায় আপনাকে কোনও কিস্তি জমা দিতে হবে না। তবে এর মানে এই নয় যে ঋণ সম্পূর্ণ মাফ হয়ে যাবে। কেবল কিস্তি দেওয়ার তারিখ পিছিয়ে যাবে। সাধারণত এক মাস থেকে ১২ মাস পর্যন্ত এই সুবিধা পাওয়া যায়, তবে তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিয়ম ও পরিস্থিতির উপর।
কোন কোন পরিস্থিতিতে মেলে এই সুবিধা?
ব্যাংক বা ঋণপ্রদানকারী সংস্থা খুব নির্দিষ্ট কিছু কারণে মোরাটোরিয়াম অনুমোদন করে। যেমন—
চাকরি চলে যাওয়া
বড়সড় ব্যবসায়িক ক্ষতি
মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি
প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদি
এই ধরনের পরিস্থিতি প্রমাণ-সহ দেখাতে পারলেই সংস্থা মোরাটোরিয়াম মঞ্জুর করে।
আবেদন করার প্রক্রিয়া
গ্রাহককে সরাসরি নিজের ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে আবেদন করতে হয়। লিখিতভাবে কারণ জানাতে হয় কেন ইএমআই স্থগিত রাখা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রমাণপত্র জমা দিতে হয়—যেমন চাকরি চলে যাওয়ার কাগজ, হাসপাতালের মেডিক্যাল রিপোর্ট বা ব্যবসায় ক্ষতির ডকুমেন্ট। আবেদন গ্রহণযোগ্য হলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কিস্তি বন্ধ রাখার অনুমতি দেয় সংস্থা।
অনুমোদন পেলে কী হয়?
যদি আবেদন মঞ্জুর হয়, তাহলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আপনার ইএমআই দিতে হবে না। সেই সময়কে বলা হয় মোরাটোরিয়াম পিরিয়ড। এই সময়সীমা যতদিন চলবে, আপনি কিস্তি না দিলেও কোনও সমস্যা হবে না। তবে সুদ জমতে থাকবে। অর্থাৎ মূল ঋণের উপর অতিরিক্ত সুদ যুক্ত হয়ে যাবে, ফলে পরে আপনার টাকার অঙ্ক আরও বাড়বে।
সুদ জমে বিপদ বাড়তে পারে
অনেকেই ভেবে নেন মোরাটোরিয়াম মানেই ঋণ থেকে মুক্তি। আসলে ব্যাপারটা উল্টো। আপনি সাময়িকভাবে স্বস্তি পেলেও ভবিষ্যতে বেশি অর্থ গুনতে হবে। কারণ যতদিন কিস্তি বন্ধ থাকবে, ততদিন আপনার ঋণের উপর সুদ জমে তা মূলধনের সঙ্গে যুক্ত হবে। ফলে কিস্তি ফের শুরু হলে মাসিক বোঝা আরও বাড়তে পারে।
কারা বেশি উপকৃত হন এই সুবিধায়?
যারা সাময়িকভাবে বিপদে পড়েছেন, তাঁদের জন্য মোরাটোরিয়াম এক রকম অক্সিজেনের মতো। যেমন—চাকরি হারিয়ে নতুন চাকরি খোঁজা, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে চিকিৎসায় মোটা অঙ্কের টাকা খরচ হওয়া বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যবসায় ক্ষতি। এই কয়েক মাসের বিরতি তাঁদের নতুন করে দাঁড়াতে সাহায্য করে।
দীর্ঘমেয়াদে কতটা লাভজনক?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুব দীর্ঘ সময়ের জন্য মোরাটোরিয়াম নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এতে সুদের বোঝা অনেকটা বেড়ে যায়। ফলে শেষমেশ টাকার চাপ দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই একেবারেই জরুরী পরিস্থিতিতে, স্বল্প সময়ের জন্য এই সুবিধা ব্যবহার করাই শ্রেয়।
গ্রাহকের করণীয়
যদি কখনও মোরাটোরিয়ামের প্রয়োজন হয়, আগে সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। শর্ত, সময়সীমা এবং অতিরিক্ত খরচ সবকিছু ভালভাবে বুঝে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ সাময়িক স্বস্তি যদি দীর্ঘমেয়াদে বেশি সমস্যার কারণ হয়, তবে তা আর্থিক পরিকল্পনাকে আরও জটিল করে দিতে পারে।জীবনে কখন কী বিপদ আসে তা কেউ জানে না। ইএমআই-এর চাপও অনেক সময় অসহনীয় হয়ে ওঠে। তবে লোন মোরাটোরিয়াম একটি জরুরী বিকল্প, যা কিছুটা হলেও শ্বাস নেওয়ার জায়গা দেয়। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সব দিক বিচার করা জরুরি। সাময়িক আরাম পেতে গিয়ে ভবিষ্যতের ঋণের বোঝা যেন বেড়ে না যায়, সেদিকে নজর রাখা দরকার।