হাইপারটেনশন: কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিরোধের উপায়

হাইপারটেনশন: কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিরোধের উপায়

হাইপারটেনশন অর্থাৎ উচ্চ রক্তচাপ, একটি স্বাস্থ্য সমস্যা যা কোনো বিশেষ লক্ষণ ছাড়াই ধীরে ধীরে শরীরকে ভেতর থেকে ক্ষতি করতে শুরু করে। একে 'নীরব ঘাতক'ও বলা হয় কারণ এর লক্ষণগুলো দেখা দেওয়ার আগে শরীরের অনেক কিছুই খারাপ হয়ে যায়। আজকালকার দৌড়াদৌড়ির জীবন, খারাপ খাদ্যাভ্যাস এবং চাপপূর্ণ দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এই রোগকে সাধারণ করে তুলেছে। কিন্তু সঠিক সময়ে এর প্রতি মনোযোগ দিলে এটিকে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

হাইপারটেনশন কী?

হাইপারটেনশন তখন হয় যখন আমাদের ধমনীতে রক্তের চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে যায়। স্বাভাবিক রক্তচাপ 120/80 mmHg ধরা হয়, কিন্তু যখন এটি 140/90 mmHg বা তার উপরে পৌঁছায়, তখন এটি উচ্চ রক্তচাপ হিসেবে বিবেচিত হয়। দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ রক্তচাপ বজায় থাকলে হৃদপিণ্ড, কিডনি এবং মস্তিষ্কের মতো অঙ্গের উপর সরাসরি প্রভাব পড়ে।

হাইপারটেনশনের প্রধান কারণ

১. অতিরিক্ত লবণ (সোডিয়াম) গ্রহণ

আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় বেশি লবণ খাওয়া রক্তচাপ বাড়ানোর সবচেয়ে বড় কারণ। নোনতা স্ন্যাকস, ফাস্ট ফুড, আচার এবং টিনজাত খাবারে সোডিয়ামের মাত্রা অনেক বেশি থাকে।

২. শারীরিক কার্যকলাপের অভাব

যারা শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকেন না, তাদের মধ্যে হাইপারটেনশনের সম্ভাবনা বেশি থাকে। অলস জীবনযাত্রা ধীরে ধীরে রক্তচাপ বাড়ায়।

৩. মানসিক চাপ এবং মানসিক চাপ

অবিরাম চাপ এবং উদ্বেগ স্নায়ুর উপর চাপ সৃষ্টি করে, যা রক্তচাপ বাড়ায়। অফিসের চাপ, পারিবারিক দায়িত্ব এবং असुरक्षा বোধ এর কারণ হতে পারে।

৪. ধূমপান ও মদ্যপান

সিগারেট এবং মদ উভয়ই রক্তনালীগুলোকে সংকুচিত করে দেয়, যার ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। দীর্ঘকাল ধরে এগুলি সেবন হৃদরোগের কারণ হতে পারে।

৫. ঘুমের সমস্যা (স্লিপ অ্যাপনিয়া)

ঘুমের মধ্যে বার বার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার সমস্যা, যাকে স্লিপ অ্যাপনিয়া বলা হয়, হাইপারটেনশনের সঙ্গে যুক্ত। এই সমস্যা মস্তিষ্ক এবং হৃদপিণ্ডের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।

৬. কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

মাঝে মাঝে কিছু বিশেষ ওষুধ যেমন ব্যথানাশক বা হরমোন সংক্রান্ত ওষুধ রক্তচাপকে প্রভাবিত করতে পারে।

৭. বংশগত কারণ

যদি আপনার পরিবারে কারো উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকে, তাহলে আপনারও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

হাইপারটেনশন থেকে হওয়া বিপদ

  • হৃদরোগ: অবিরাম উচ্চ রক্তচাপ হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট ফেইলিওরের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়।
  • স্ট্রোকের ঝুঁকি: মস্তিষ্কের স্নায়ুর উপর চাপ বাড়লে ব্রেইন স্ট্রোক হতে পারে।
  • কিডনি ড্যামেজ: কিডনির স্নায়ুর উপর প্রভাব পড়লে ধীরে ধীরে কিডনি খারাপ হয়ে যেতে পারে।
  • চোখের দৃষ্টিশক্তির উপর প্রভাব: চোখের স্নায়ুতে রক্তের চাপ বাড়লে দৃষ্টিশক্তি হারাতে হতে পারে।

হাইপারটেনশন থেকে বাঁচা এবং চিকিৎসা

১. লবণের ব্যবহার কম করুন

প্রতিদিন ৫ গ্রামের কম লবণ খাওয়ার চেষ্টা করুন। ফাস্ট ফুড, টিনজাত জিনিস এবং আচার থেকে দূরে থাকুন।

২. স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাবার খান

ফল, সবজি, গোটা শস্য এবং কম ফ্যাটযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্য খান। ভাজা এবং ফ্যাটযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।

৩. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন

স্থূলতা উচ্চ রক্তচাপের প্রধান কারণ। ওজন কমালে ব্লাড প্রেসার নিজে থেকেই নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করে।

৪. নিয়মিত ব্যায়াম করুন

প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটা, যোগ ব্যায়াম বা সাইকেল চালানো উপকারী।

৫. চাপ থেকে দূরে থাকুন

যোগা, ধ্যান, সঙ্গীত বা শখের প্রতি সময় দিয়ে নিজেকে মানসিকভাবে শান্ত রাখুন।

৬. ধূমপান এবং মদ্যপান ত্যাগ করুন

এই দুটিই আপনার স্বাস্থ্যের সবচেয়ে বড় শত্রু। এগুলো ত্যাগ করলে বিপি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

৭. পর্যাপ্ত ঘুমোন

রাতে ৭-৮ ঘণ্টা গভীর ঘুম প্রয়োজন। ঘুমের অভাব হাইপারটেনশনকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে।

৮. নিয়মিত পরীক্ষা করান

প্রতি ৩-৬ মাসে রক্তচাপ পরীক্ষা করানো জরুরি, যাতে পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আগে চিকিৎসা শুরু করা যায়।

হাইপারটেনশন কোনো ছোটখাটো রোগ নয়। এটি ধীরে ধীরে শরীরকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দেয়। কিন্তু ভালো দিক হল, সামান্য শৃঙ্খলা এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে এটি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাই এখন থেকেই নিজের জীবনযাত্রার দিকে নজর দিন, যাতে ভবিষ্যতে আপনার হৃদয়, মস্তিষ্ক এবং শরীর সুস্থ থাকতে পারে।

Leave a comment