প্রতি বছর ১৫ই আগস্ট ভারতে একটি বিশেষ উৎসব হিসেবে পালিত হয় — স্বাধীনতা দিবস। এই দিনটিতে ভারত ২০০ বছরের দীর্ঘ পরাধীনতার পর ব্রিটিশ শাসনের কবল থেকে মুক্তি লাভ করে। কিন্তু এই দিনটি শুধুমাত্র পতাকা উত্তোলন বা ভাষণ দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি আমাদের স্বাধীনতার মূল্য, আমাদের পূর্বপুরুষদের আত্মত্যাগ এবং ভারতের আত্মাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
ইংরেজদের আগমন ও দাসত্বের শুরু
ইংরেজরা ১৬০০-এর দশকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে বাণিজ্য করার অজুহাতে ভারতে আসে। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা ভারতের ওপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর যখন ব্রিটিশ সরকার সরাসরি ভারতকে নিজেদের অধীনে নিয়ে নেয়, তখন থেকেই শুরু হয় দাসত্বের কালো অধ্যায়। আমাদের নিজেদের ভূমিতেই আমাদের ক্রীতদাস করে রাখা হয়েছিল। ভারতীয়দের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হত। আমাদের সম্পদ লুট করা হয়েছিল, আমাদের সংস্কৃতিকে অপমান করা হয়েছিল এবং আমাদের কণ্ঠস্বরকে दबाণো হয়েছিল।
সংগ্রামের স্ফুলিঙ্গ: যখন ভারত মাথা তুলে দাঁড়ালো
ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধ সহজ ছিল না। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত, বহু আন্দোলন হয়েছে এবং হাজার হাজার মানুষ নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে সত্যাগ্রহ ও অহিংসার পথ জনগণের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে, তেমনই ভগত সিং, সুভাষ চন্দ্র বসু এবং চন্দ্রশেখর আজাদের মতো বিপ্লবীরা তাদের সাহস দিয়ে ব্রিটিশ শাসনের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই সমস্ত সংগ্রাম স্বাধীনতা যুদ্ধকে আরও শক্তিশালী করেছিল।
প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে মানুষ স্বাধীনতার আশা জ্বালিয়ে রেখেছিল। কেউ কলম ধরে যুদ্ধ চালিয়েছে, কেউ কারাগারে পচে মরেও সাহস হারায়নি। গ্রাম-গঞ্জ, শহর-নগরে আন্দোলনের ঢেউ উঠেছিল। মহিলারাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নিয়েছিলেন। এটাই ছিল সেই আবেগ যা একদিন ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্টের সকালকে বাস্তবে পরিণত করেছিল — যখন ভারত প্রথমবার খোলাখুলিভাবে স্বাধীনতার নিঃশ্বাস নিয়েছিল।
অহিংসা থেকে স্বাধীনতা: গান্ধীজির পথ
মহাত্মা গান্ধী স্বাধীনতা সংগ্রামে অহিংসা ও সত্যাগ্রহের পথ বেছে নিয়েছিলেন। তিনি ১৯১৫ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত অনেক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন —
- লবণ সত্যাগ্রহ
- অসহযোগ আন্দোলন
- ভারত ছাড়ো আন্দোলন
গান্ধীজি বিনা অস্ত্রে, কিন্তু দৃঢ় সংকল্পের সাথে ব্রিটিশ সরকারকে নতি স্বীকার করতে বাধ্য করেছিলেন। তাঁর বার্তা ছিল – "করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে"।
ঐতিহাসিক দিন: ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭
অবশেষে, লক্ষ লক্ষ আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের পর, ভারত ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা লাভ করে। এই দিনে, পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু লাল কেল্লা থেকে ভারতের প্রথম ভাষণ দিয়েছিলেন — 'Tryst with Destiny'। সেই দিন প্রথমবার স্বাধীন ভারতের মাটিতে তেরঙ্গা পতাকা পূর্ণ মর্যাদার সাথে উত্তোলন করা হয়েছিল। এই দিনটি শুধু স্বাধীনতার নয়, ভারতের পুনর্জন্মের দিন ছিল।
কেন ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয়?
স্বাধীনতা দিবস ১৫ই আগস্টে পালন করা হয় কারণ এই দিনেই ১৯৪৭ সালে ভারত ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল। এই দিনটি পালনের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র উৎসব করা নয়, বরং সেই লক্ষ লক্ষ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মরণ করা, যারা দেশের জন্য নিজেদের সবকিছু উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁদের আত্মত্যাগের ফলেই আমরা এই স্বাধীন বাতাসে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। এছাড়াও এই দিনটি প্রতিটি ভারতীয়কে নিজের দেশের প্রতি গর্ব, ভালোবাসা এবং একতার भावना জাগিয়ে তোলে। স্কুল, কলেজ ও সরকারি অফিসে পতাকা উত্তোলন করা হয়, দেশাত্মবোধক গান গাওয়া হয় এবং দেশের অগ্রগতি স্মরণ করা হয়। এই দিনটি নতুন প্রজন্মকে বোঝানোর একটি মাধ্যম যে স্বাধীনতা কত মূল্যবান।
কীভাবে স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয়?
ভারতের প্রতিটি প্রান্তে ১৫ই আগস্ট অত্যন্ত গর্ব ও আনন্দের সাথে পালিত হয়:
- দিল্লির লাল কেল্লায় প্রধানমন্ত্রী তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলন করেন এবং দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন।
- স্কুল-কলেজে প্যারেড, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বক্তৃতা এবং দেশাত্মবোধক গান গাওয়া হয়।
- প্রতিটি গলি, প্রতিটি মহল্লায় পতাকা উত্তোলন ও মিষ্টি বিতরণ করা হয়।
- সোশ্যাল মিডিয়ায় দেশাত্মবোধের ঢেউ লাগে — সবার প্রোফাইল তেরঙ্গায় সেজে ওঠে।
স্বাধীনতার আসল মানে: শুধু উদযাপন নয়, দায়িত্বও
স্বাধীনতার মানে শুধু পতাকা উত্তোলন করা নয়, বরং সেই স্বাধীনতাকে ধরে রাখাও আমাদের দায়িত্ব। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীর শুধু এই জন্যেই আত্মত্যাগ করেননি যে আমরা প্রতি বছর তেরঙ্গা ওড়াব, বরং এই জন্য যে আমরা এমন একটি দেশ তৈরি করব যেখানে সবাই সমান, সবাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ন্যায়বিচার পায়। স্বাধীনতার আসল সম্মান তখনই হবে যখন আমরা একজন ভালো নাগরিক হয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখব। স্বাধীনতা দিবস শুধু উৎসব নয়, আত্মবিশ্লেষণেরও সুযোগ। আমাদের নিজেদেরকে জিজ্ঞাসা করা উচিত — আমরা কি সেই মূল্যবোধগুলি পালন করছি, যেগুলোর জন্য আমাদের পূর্বপুরুষরা সংগ্রাম করেছিলেন? আমরা কি সমাজে ছড়িয়ে থাকা বৈষম্য, দুর্নীতি ও ঘৃণা দূর করার চেষ্টা করছি? দেশের সত্যিকারের সেবা হল আমরা যেন আমাদের আশেপাশে পরিবর্তন আনতে পারি, সততার সাথে কাজ করি এবং ঐক্যবদ্ধভাবে ভারতকে আরও উন্নত করি।
১৫ই আগস্ট শুধু একটি তারিখ নয়, বরং ভারতবাসীর एकता, সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগের পরিচয়। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা অনেক কষ্টের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে এবং এটিকে ধরে রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব। আমাদের নিজেদের কর্তব্য পালন করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আসুন, এই স্বাধীনতা দিবসে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিজ্ঞা করি যে আমরা একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ ভারত গঠনে योगदान দেব।