ইন্দিরা গান্ধী: এক লৌহ মানবীর উত্থান, দেশ ও বিশ্ব রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব

ইন্দিরা গান্ধী: এক লৌহ মানবীর উত্থান, দেশ ও বিশ্ব রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব

ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী, তাঁর দৃঢ় নেতৃত্ব, বৈশ্বিক কূটনীতি এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রেখেছেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ, ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ এবং " गरीबी हटाओ " (দারিদ্র্য দূরীকরণ) মতো কর্মসূচি তাঁর উত্তরাধিকারের অংশ।

ইন্দিরা গান্ধী: ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। ১৯শে নভেম্বর, ১৯১৭ সালে উত্তর প্রদেশের প্রয়াগরাজে (তৎকালীন এলাহাবাদ) জন্মগ্রহণ করেন, ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রথম এবং আজ পর্যন্ত একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি কেবল তাঁর রাজনৈতিক দক্ষতার জন্যই নন, বরং তাঁর ব্যক্তিগত সাহস, দৃঢ় নেতৃত্ব এবং দেশপ্রেমের জন্যও বিশ্বজুড়ে পরিচিত।

প্রারম্ভিক জীবন এবং শিক্ষা

ইন্দিরা গান্ধীর জন্ম ইন্দিরা নেহেরু নামে। তাঁর পিতা জওহরলাল নেহেরু ছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর মা কমলা নেহেরু। ইন্দিরা গান্ধীর জীবনের শুরুটা বেশ কঠিন এবং একাকী ছিল। তাঁর পিতা প্রায়শই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকতেন এবং মায়ের স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে তাঁর যত্ন সীমিত ছিল।

ইন্দিরা তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা বাড়িতে গৃহশিক্ষকদের কাছ থেকে লাভ করেন। পরে তিনি দিল্লির মডার্ন স্কুল, এলাহাবাদের সেন্ট সেসিলিয়া এবং সেন্ট মেরি কনভেন্ট স্কুলে অধ্যয়ন করেন। তাঁর শিক্ষার যাত্রায় বিদেশও অন্তর্ভুক্ত ছিল; তিনি জেনেভার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, সুইজারল্যান্ডের একোল নোভেল এবং পুনের পিপলস ওন স্কুলে অধ্যয়ন করেন। পরে তিনি আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক শিক্ষার জন্য বেলুর মঠ এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতনেও পড়াশোনা করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নাম রেখেছিলেন "ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী", যার অর্থ হল - কোমলতা ও করুণার সাথে সবকিছু দেখা। তাঁর জীবনের প্রাথমিক পর্যায়টি অসুস্থতা এবং কষ্টের সঙ্গে পরিপূর্ণ ছিল, কিন্তু এসবের পরেও তিনি শিক্ষা এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখিয়েছেন।

পারিবারিক জীবন এবং বিবাহ

ইন্দিরা গান্ধীর বিবাহ হয় ফিরোজ গান্ধীর সাথে, যিনি গুজরাটি পার্সি পরিবারের ছিলেন। এই বিবাহে তাঁর দুই পুত্র হয়: রাজীব গান্ধী এবং সঞ্জয় গান্ধী। তাঁর পারিবারিক জীবন তাঁকে রাজনীতির সূক্ষ্ম বিষয়গুলির সাথে পরিচিত করিয়েছিল এবং স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক পরিবেশে তাঁর পথ সুগম করেছিল।

রাজনৈতিক জীবনের সূচনা

ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক কর্মজীবন তাঁর পিতার নির্দেশনায় শুরু হয়েছিল। জওহরলাল নেহেরুর সময়ে ইন্দিরা তাঁর সাথে অনেক বিদেশি সফরে অংশ নিয়েছিলেন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। ১৯৫৯ সালে, কংগ্রেস পার্টির সভাপতি হিসেবে, তিনি তাঁর কর্মক্ষমতা এবং রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে কেরালায় কমিউনিস্ট সরকারকে ভেঙে দেন।

১৯৬৪ সালে নেহেরুর মৃত্যুর পর, তাঁকে রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত করা হয় এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মন্ত্রিসভায় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। জানুয়ারি ১৯৬৬ সালে শাস্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যুর পর, কংগ্রেস পার্টি তাঁকে দলের সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করে ভারতের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্পণ করে।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রাথমিক বছর (১৯৬৬-১৯৬৭)

ইন্দিরা গান্ধীর প্রথম মেয়াদ ছিল চ্যালেঞ্জ এবং সমালোচনার সঙ্গে পরিপূর্ণ। তাঁকে কংগ্রেস পার্টির সিনিয়র নেতারা "গুঁগী গুড়িয়া" (বোবা পুতুল) বলে অভিহিত করেছিল, যার অর্থ ছিল তিনি কেবল দলীয় নেতাদের হাতের পুতুল। কিন্তু তিনি তাঁর সাহস এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিয়ে এই ধারণাটিকে ভুল প্রমাণ করেন।

তাঁর প্রথম বড় পদক্ষেপগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল মিজোরামে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের বিদ্রোহ দমন। এর পাশাপাশি তিনি পররাষ্ট্রনীতি এবং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৬৭-১৯৭১: নির্বাচন এবং নীতিগত পরিবর্তন

১৯৬৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস তার বেশিরভাগ রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর কেন্দ্র রায়বেরেলি থেকে লোকসভায় প্রবেশ করেন। এই সময়ে তিনি ধীরে ধীরে সমাজতান্ত্রিক নীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন।

১৯৬৯ সালে, তিনি কংগ্রেস পার্টির সিনিয়র নেতাদের সাথে মতবিরোধের সম্মুখীন হন। তিনি ভি.ভি. গিরিকে সমর্থন করেন এবং দেশের ১৪টি বড় ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করেন। এর ফলস্বরূপ, তাঁকে কংগ্রেস পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়, কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী তাঁর নতুন দল কংগ্রেস (আর) গঠন করেন এবং বেশিরভাগ সাংসদের সমর্থন লাভ করেন।

চীন এবং সীমান্ত বিরোধ

১৯৬৭ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত ও চীনের মধ্যে হিমালয় সীমান্তে সামরিক সংঘাত হয়েছিল, যা ভারত সফলভাবে মোকাবিলা করেছিল। এছাড়াও, ১৯৭৫ সালে তিনি সিকিমকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করেন, যা তাঁর কঠোর এবং দৃঢ় নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।

১৯৭১ সালের যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের মুক্তি

ইন্দিরা গান্ধীর সবচেয়ে বড় সামরিক এবং রাজনৈতিক অবদান ছিল ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের মুক্তি। পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) বিদ্রোহীদের সমর্থন করে তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্রুত এবং নির্ণায়ক পদক্ষেপ নিশ্চিত করেন।

এই যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী অসাধারণ কৌশল এবং দ্রুততার সঙ্গে কাজ করে ঢাকা দখল করে এবং ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সেনা বন্দী হয়, যা বিশ্ব ইতিহাসে অন্যতম বৃহত্তম আত্মসমর্পণের ঘটনা ছিল।

দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সামাজিক নীতি

১৯৭১ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় ইন্দিরা গান্ধী " गरीबी हटाओ " (দারিদ্র্য দূরীকরণ) স্লোগান দিয়েছিলেন। এই নীতি দারিদ্র্য দূরীকরণ, গ্রামীণ উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল। এই নীতির মাধ্যমে তিনি গ্রামীণ ও শহুরে দরিদ্রদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করেছিলেন।

ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং জরুরি অবস্থা

১৯৭৫-১৯৭৭ সালের মধ্যে, ইন্দিরা গান্ধী ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করেন, যেখানে নাগরিক স্বাধীনতা সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছিল। এই সময়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। যদিও এই পদক্ষেপ বিতর্কিত ছিল, এটিকে ইন্দিরা গান্ধীর দৃঢ় এবং নির্ভীক নেতৃত্ব হিসেবেও দেখা হয়।

বৈশ্বিক স্তরে নেতৃত্ব এবং নীতি

ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্বকালে ভারত পারমাণবিক শক্তি পরীক্ষা (১৯৭৪) করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে। এছাড়াও, তিনি চীন ও পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্ব "আয়রন লেডি" (লৌহ মানবী) নামে পরিচিতি লাভ করে।

মৃত্যু এবং উত্তরাধিকার

৩১শে অক্টোবর, ১৯৮৪ সালে, শিখ চরমপন্থীদের হাতে ইন্দিরা গান্ধী নিহত হন। এর কারণ ছিল অপারেশন ব্লু স্টার। তাঁর মৃত্যু ভারত এবং বিশ্ব রাজনীতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি ছিল।

তাঁর উত্তরাধিকারের মধ্যে রয়েছে:

  • ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হওয়া
  • বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নির্ণায়ক ভূমিকা
  • সামাজিক ন্যায়বিচার এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের নীতি
  • বৈশ্বিক মঞ্চে ভারতের শক্তিশালী নেতৃত্ব

ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় রাজনীতিতে কেবল মহিলাদের জন্যই নতুন পথ খোলেননি, বরং দেশকে বৈশ্বিক মঞ্চে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁর সাহস, দূরদৃষ্টি এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি অঙ্গীকার তাঁকে এক অনন্য এবং অনুপ্রেরণাদায়ক নেতা করে তুলেছে। তাঁর নেতৃত্ব আজও দেশবাসীর জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।

Leave a comment