১৯২৪ সালের ২৫শে ডিসেম্বর গোয়ালিয়রের মাটিতে অটল বিহারী বাজপেয়ীর জন্ম। তিনি কেবল একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক যুগ, একটি আদর্শের বাহক এবং এমন একজন কবি যাঁর কলম ক্ষমতার অলিন্দেও অনুরণিত হত। ভারতীয় রাজনীতিতে অটল জীর প্রবেশ কেবল ক্ষমতা পাওয়ার জন্য ছিল না, বরং জনসেবা ও রাষ্ট্র নির্মাণের একটি ব্রত ছিল, যা তিনি জীবনভর পালন করেছিলেন।
প্রাথমিক জীবন: শিক্ষক পুত্র থেকে ভারতরত্ন
অটল জীর পিতা কৃষ্ণ বিহারী বাজপেয়ী স্বয়ং একজন শিক্ষক ও কবি ছিলেন, যাঁর থেকে অটলজী সাহিত্য ও নৈতিক মূল্যবোধ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। গোয়ালিয়রে শিক্ষা গ্রহণের সময়ই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সাথে যুক্ত হয়ে তিনি রাষ্ট্র সেবার পথ বেছে নেন। কানপুর থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ. ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি সাংবাদিকতা ও লেখার মাধ্যমে সমাজকে দিশা দেখাতে শুরু করেন।
রাজনীতির সূচনা: বাণীতেই বিজয়
১৯৫৭ সালে बलरामপুর থেকে লোকসভার প্রথম নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি সংসদীয় জীবনের সূচনা করেন। এখান থেকেই তাঁর বাণীর শক্তি সংসদে তাঁকে বিশেষ পরিচিতি এনে দেয়। তাঁর ভাষণে তথ্য, যুক্তি ও তেজস্বিতার সংমিশ্রণ থাকত, যা তাঁকে অন্য নেতাদের থেকে আলাদা করত। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ভারতীয় জনসংঘের সভাপতি হিসেবে তিনি দলের আদর্শকে আরও শক্তিশালী করেন। তারপর ১৯৮০ সালে ভারতীয় জনতা পার্টির গঠনে তিনি निर्णायक ভূমিকা পালন করেন এবং প্রথম সভাপতি হন।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যাত্রা: তিনবার, তিনটি অভিজ্ঞতা
অটলজী তিনবার প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করেন:
- প্রথমবার মাত্র ১৩ দিনের (মে ১৯৯৬) স্বল্পমেয়াদী সরকার।
- দ্বিতীয়বার ১৯৯৮ সালে আট মাসের জোট সরকার।
- তৃতীয়বার ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের স্থিতিশীল সরকার – যা জোট রাজনীতির স্থিতিশীলতার উদাহরণ সৃষ্টি করে।
তিনি ছিলেন প্রথম অকংগ্রেসী প্রধানমন্ত্রী যিনি কোনো বাধা ছাড়াই পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করেছিলেন। এটি জোট সরকারগুলোর জন্য একটি ঐতিহাসিক উদাহরণ হয়ে রয়েছে।
বৈশ্বিক দিগন্তে ভারত: পোখরান ও কূটনীতি
১৯৯৮ সালে পোখরান-II পরমাণু পরীক্ষা করে ভারতকে আত্মনির্ভর এবং আত্মমর্যাদা সম্পন্ন রাষ্ট্রে পরিণত করেন। মার্কিন স্যাটেলাইটকে ফাঁকি দিয়ে এই পরীক্ষা ছিল অভাবনীয় রণনীতির প্রমাণ। এরপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞারও তিনি দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করেন। তিনি পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করারও চেষ্টা করেছিলেন। দিল্লি-লাহোর বাস সার্ভিস এবং নওয়াজ শরিফের সাথে সংলাপ এর উদাহরণ। তবে কার্গিল যুদ্ধ সেই শান্তি প্রচেষ্টাকে ধাক্কা দেয়, কিন্তু অটলজী সীমান্তের মর্যাদা রক্ষা করে সেনাবাহিনীকে কৌশলগতভাবে বিজয় এনে দেন।
উন্নয়নের দিশা: স্বর্ণালী চতুর্ভুজ এবং পরিকাঠামোগত বিপ্লব
অটলজী দেশের মৌলিক পরিকাঠামোকে পুনর্গঠন করেন। ‘স্বর্ণালী চতুর্ভুজ প্রকল্প’-এর অধীনে দেশের চারটি কোণকে সংযোগকারী রাস্তা তৈরি করে তিনি আধুনিক ভারতের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেন। তাঁর শাসনকালে যে উন্নয়নের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল, তা ভবিষ্যৎ সরকারগুলোর জন্য মানদণ্ড স্থাপন করে দেয়। টেলিযোগাযোগ, সড়ক, রেল, বিদ্যুৎ, জল এবং তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে অটল যুগকে ভারতের মৌলিক বিপ্লব হিসেবে দেখা হয়।
কবি ও চিন্তাবিদ: ক্ষমতায় থেকেও সংবেদনশীল
রাজনীতির কোলাহলের মধ্যেও অটলজীর ভেতরের কবি সর্বদা জীবিত ছিলেন। 'মেরী ইক্ক্যাবন কবিতায়েঁ', 'কৈদী কবিরায় কী কুন্ডলিয়াঁ', 'অমর আগ হ্যায়' এর মতো সৃষ্টিতে তাঁর সংবেদনশীলতা, দেশপ্রেম এবং আত্মসমীক্ষণ প্রতিফলিত হয়। তিনি নিজে বলেছিলেন: 'মেরী কবিতা জঙ্গ কা এলান হ্যায়, পরাজয় কি প্রস্তাবনা নহীঁ।' তাঁর কবিতা ক্ষমতার অলিন্দে পরিশীলিত এবং আত্মার আহ্বান হয়ে ধ্বনিত হত।
শেষ পর্যায়: নীরবতার মহিমা
২০০৫ সালের পর অটলজী সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন। কিন্তু দেশের মানচিত্রে তাঁর উপস্থিতি বজায় ছিল। ২০১৫ সালে তাঁকে ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত করা হয়, এই সম্মান কেবল একজন নেতাকে নয়, বরং এক যুগপুরুষকে দেওয়া হয়েছিল। ২০১৮ সালের ১৬ই আগস্ট অটলজী যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, তখন পুরো দেশ কেঁদেছিল। তাঁর শেষ যাত্রায় লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা জানায়। রাজঘাটের কাছে ‘সদৈব অটল’ নামে তাঁর সমাধি তৈরি হয়েছে, যা আজও দেশের প্রতি তাঁর নিষ্ঠার সাক্ষ্য দেয়।
অটল প্রেরণা: আজকের ভারতের জন্য
অটল বিহারী বাজপেয়ী কেবল অতীতকালের স্মৃতি নন। তিনি বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য অনুপ্রেরণা। তাঁর ব্যক্তিত্ব শেখায় যে, সত্য, সংলাপ ও সংবেদনশীলতার সাথেও রাজনীতি করা যায়। তিনি ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও সংযত ও বিনম্র ছিলেন। তিনি রাজনীতিকে সেবার মাধ্যম মনে করতেন এবং ভারতকে নিজের কবিতার বিষয়। তিনি সত্যই 'ভারত মাতার सच्चे सपूत' ছিলেন, যিনি জীবনের শেষ শ্বাস পর্যন্ত দেশের সেবা করেছেন।
অটল বিহারী বাজপেয়ীর জীবন একটি কবিতা – বীর রসে পরিপূর্ণ, নীতি দ্বারা চালিত এবং দেশপ্রেম দ্বারা অভিষিক্ত। তিনি দেখিয়েছেন যে রাজনীতি কেবল ক্ষমতার খেলা নয়, বরং দেশ সেবার ব্রত। তাঁর জীবন ও চিন্তা আজও প্রাসঙ্গিক – যখনই রাষ্ট্র সংকটে পড়ে, যখনই সংলাপের প্রয়োজন হয়, যখনই উন্নয়নের দিক নির্ধারণ করতে হয় – অটলজীর বাণী ও নীতি অনুপ্রেরণা যোগায়।