এই বছর শ্রাবণ মাসের শুরু ১১ই জুলাই থেকে হয়েছে এবং গোটা উত্তর ভারতে কাওড় যাত্রার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। প্রতি বছরের মতো এবারও লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী গঙ্গা জল নিতে হরিদ্বার, গঙ্গোত্রী, গোমুখ, নীলকণ্ঠ এবং অন্যান্য পবিত্র স্থানগুলির দিকে পায়ে হেঁটে রওনা হচ্ছেন।
আগে যেখানে এই যাত্রা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যুবক পুরুষেরা একা অথবা বন্ধুদের সঙ্গে মিলে করতেন, সেখানে গত কয়েক বছর ধরে পুরো পরিবারের একসঙ্গে কাওড় কাঁধে নেওয়ার চল দ্রুত বেড়েছে। মা-বাবা থেকে শুরু করে ছোট ছোট শিশুরাও এই যাত্রায় অংশ নিচ্ছে।
একসঙ্গে যাত্রা করলে বাড়ে প্রেম ও আপনত্ব
পরিবারিকভাবে কাওড় যাত্রায় অংশ নেওয়ার ফলে পারস্পরিক সম্পর্কের দৃঢ়তা আসে। যাত্রাপথে প্রত্যেক সদস্য একে অপরের সাহায্য করে, একসঙ্গে পথ চলে, একই উদ্দেশ্যে এগিয়ে যায়। এই সামষ্টিকতা পারিবারিক সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দেয়।
দুপুরের রোদ, রাতের ক্লান্তি, পথের কষ্ট—এসবের মোকাবিলা যখন পুরো পরিবার একসঙ্গে করে, তখন পারস্পরিক বিশ্বাস ও বোঝাপড়া আরও গভীর হয়।
ভক্তি ও ভজন-কীর্তনে আধ্যাত্মিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়
রাস্তাজুড়ে 'বোল বোম'-এর জয়ধ্বনিতে চারপাশ মুখরিত হয়। ঢোল, করতাল, শঙ্খ এবং ভজনের মধুর ধ্বনি প্রত্যেক কাওড়ীর মনকে শান্তি দেয়। যখন পুরো পরিবার এই ভক্তিগানে একসঙ্গে মিলিত হয়, তখন যাত্রা কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ না থেকে আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়।
এই পরিবেশে শিশুরাও শিব ভক্তির সংস্কার গ্রহণ করে এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ বুঝতে শুরু করে। পরিবার পরিজনের সঙ্গে এই যাত্রা সারা জীবনের জন্য একটি অনুপ্রেরণামূলক অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে।
পিতৃ দোষ থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা
ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, শ্রাবণ মাসে ভগবান শিবকে গঙ্গা জল অর্পণ করলে পিতৃ দোষ, কুল দোষ এবং গ্রহ বাধা শান্ত হয়। যখন কোনো ব্যক্তি পুরো পরিবারের সঙ্গে এই যাত্রা করে এবং শিবলিঙ্গের উপর জল অর্পণ করে, তখন তা পুরো বংশের কল্যাণের কারণ হয়।
কথিত আছে, শিব ভক্তিতে যখন গোটা কুল একসঙ্গে মিলিত হয়, তখন তারা শিবের কৃপায় পিতৃপুরুষদের আশীর্বাদ লাভ করে এবং পরিবারে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় থাকে।
মহিলা ও বয়স্কদের অংশগ্রহণও বাড়ছে
এখন কাওড় যাত্রা কেবল যুবকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। অনেক পরিবারে মহিলারা, মায়েরা এবং বয়স্ক ব্যক্তিরাও খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে এতে অংশ নিচ্ছেন। মহিলারা তাদের সন্তানদের সঙ্গে 'ছোট কাওড়' নিয়ে হেঁটে যান এবং শিবের স্তুতি করেন।
বয়স্কদের সঙ্গে যাত্রা করলে নতুন প্রজন্ম তাদের অভিজ্ঞতা ও ধর্মীয় জ্ঞান থেকে উপকৃত হয়। এর ফলে পারিবারিক ঐতিহ্য আরও শক্তিশালী হয়।
শিশুদের উপরও ইতিবাচক প্রভাব পড়ে
এই যাত্রার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল শিশুদের উপর এর প্রভাব। যখন শিশুরা তাদের মা-বাবা এবং ঠাকুরদাদাকে কঠিন যাত্রায় এগিয়ে যেতে দেখে, তখন তাদের মনেও ধর্মীয় আস্থা গভীর ভাবে গেঁথে যায়।
রাস্তায় দেখা যাওয়া সাধু-সন্ন্যাসী, শিব মন্দির, কথা-কীর্তন এবং সেবার মনোভাব শিশুদের ভারতীয় সংস্কৃতির জীবন্ত রূপ দেখায়। এটি তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ এবং চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কাওড় যাত্রার গভীর রহস্য
শ্রাবণ মাসে কাওড় যাত্রা কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি উৎসর্গ, ধৈর্য, অনুশাসন এবং আত্মিক শুদ্ধির প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হয়। যখন পুরো পরিবার একসঙ্গে এই যাত্রা করে, তখন এতে কেবল শরীরের অংশগ্রহণ থাকে না, মন, আত্মা এবং অনুভূতি—সবকিছুই যুক্ত হয়।
এই যাত্রার প্রতিটি পর্যায়ে ভক্তির ভাব, সংযমের পরীক্ষা এবং সেবার সুযোগ লুকিয়ে থাকে। বাড়ি থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে গিয়ে জল আনা এবং সেটি শিবলিঙ্গের উপর অর্পণ করা—এই পুরো প্রক্রিয়াটি একটি সাধনার রূপ নেয়।
প্রতি পদক্ষেপে সেবা ও সহযোগিতার অনুভূতি পাওয়া যায়
কাওড় যাত্রার সময় রাস্তার বিভিন্ন স্থানে সেবা শিবিরগুলি তৈরি হয়, যেখানে যাত্রীদের বিনামূল্যে খাবার, জল, ঔষধ এবং বিশ্রাম নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এই সেবার মনোভাব প্রত্যেককে একে অপরের সাহায্য করার জন্য উৎসাহিত করে।