খাটু শ্যাম: মহাভারতের বর্বরিকের আত্মত্যাগ এবং কলিযুগের ‘হেরে যাওয়াদের আশ্রয়’ হওয়ার গল্প

খাটু শ্যাম: মহাভারতের বর্বরিকের আত্মত্যাগ এবং কলিযুগের ‘হেরে যাওয়াদের আশ্রয়’ হওয়ার গল্প

রাজস্থানের সিকর জেলায় অবস্থিত খাটু শ্যাম মন্দির কোটি কোটি ভক্তের আস্থার কেন্দ্র। খাটু শ্যামজিকে মহাভারতের বীর বর্বরিক বলে মনে করা হয়, যিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর মস্তক দান করেছিলেন। তাঁর এই ত্যাগে সন্তুষ্ট হয়ে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে কলিযুগে নিজের আগে পূজিত হওয়ার বরদান দিয়েছিলেন, এই কারণেই তাঁকে 'হেরে যাওয়াদের আশ্রয়' বলা হয়।

Khatu Shyam Story: রাজস্থানের সিকর জেলায় অবস্থিত খাটু শ্যাম মন্দিরে প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্ত দর্শন করতে আসেন। মহাভারত কালের বীর বর্বরিককে এখানে খাটু শ্যাম রূপে পূজা করা হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধের আগে বর্বরিকের কাছে তাঁর মস্তক চেয়েছিলেন এবং তাঁর অসাধারণ ত্যাগে প্রসন্ন হয়ে তাঁকে কলিযুগে ‘শ্যাম’ নামে পূজিত হওয়ার আশীর্বাদ দিয়েছিলেন। এই মন্দিরটি বিশেষ করে হেরে যাওয়া এবং হতাশ ভক্তদের জন্য আশার প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয়, কারণ বিশ্বাস করা হয় যে যে ব্যক্তি সত্য মনে বাবা শ্যামের নাম জপ করে, তার সমস্ত মনস্কামনা পূর্ণ হয়।

মহাভারতের বীর বর্বরিকের অনন্য কাহিনী

রাজস্থানের সিকর জেলায় অবস্থিত খাটু শ্যামজির মন্দির আজ কোটি কোটি ভক্তের আস্থার প্রধান কেন্দ্র। প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্ত এখানে পৌঁছে বাবা খাটু শ্যামের দরবারে মাথা নত করেন। ভক্তরা তাঁকে "হেরে যাওয়াদের আশ্রয়", "শীশের দাতা" এবং কলিযুগের কৃষ্ণ নামে ডাকেন। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, খাটু শ্যামজি সেই দেবতা যিনি হতাশ ব্যক্তির জীবনতরীও পার করে দেন। তাঁর ভক্তরা বলেন, যখন সব পথ বন্ধ বলে মনে হয়, তখন বাবা শ্যামের নামই শেষ আশ্রয় হয়।

কিন্তু খাটু শ্যামজি আসলে কে ছিলেন? এবং কেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে এই অসাধারণ বরদান দিয়েছিলেন যে তিনি কলিযুগে স্বয়ং কৃষ্ণের আগে পূজিত হবেন? এই প্রশ্নের উত্তর মহাভারত কালের এক অনন্য কাহিনীতে পাওয়া যায়, যেখানে ত্যাগ, ভক্তি এবং ধর্মের গভীর বার্তা লুকানো আছে।

পান্ডব বংশের বীর এবং তিন বাণের অধিকারী

কাহিনী অনুসারে, খাটু শ্যামজি আসলে মহাভারত কালের বীর বর্বরিক ছিলেন। তিনি পান্ডবদের নাতি এবং মহাবলী ভীমের পৌত্র ছিলেন। তাঁর পিতা ঘটোৎকচ এবং মাতা মোরবী। জন্ম থেকেই বর্বরিক অদ্ভুত শক্তি এবং দিব্য গুণে সম্পন্ন ছিলেন। বলা হয় যে দেবী চন্ডিকার কাছ থেকে তিনি তিনটি অনন্য বাণ পেয়েছিলেন, যার শক্তি সমগ্র সৃষ্টিকে কাঁপিয়ে দিতে পারত। এই বাণগুলির কারণেই তিনি তিন বাণধারী নামেও পরিচিত ছিলেন।

এই বাণগুলির শক্তি এমন ছিল যে প্রথম বাণটি শত্রুকে চিনতে পারত, দ্বিতীয়টি প্রতিটি লক্ষ্যকে বেঁধে দিত এবং তৃতীয়টি শুধুমাত্র একটি ইশারায় সমগ্র শত্রু গোষ্ঠীর অবসান ঘটাতে পারত। অর্থাৎ, বর্বরিক একাই মুহূর্তের মধ্যে পুরো যুদ্ধের সিদ্ধান্ত বদলে দিতে পারতেন।

মাতার কাছে করা প্রতিশ্রুতি এবং ধর্মের পথ

মহাভারতের যুদ্ধ শুরু হওয়ার উপক্রম হলে, বর্বরিকও রণভূমিতে নামতে চেয়েছিলেন। যাওয়ার আগে তিনি তাঁর মাতাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি সর্বদা হেরে যাওয়া পক্ষের সঙ্গে থাকবেন। এই প্রতিশ্রুতি তাঁর দৃঢ় নিষ্ঠা এবং ধর্মের প্রতি समर्पणকে নির্দেশ করে। কিন্তু এই সংকল্পই ভবিষ্যতে যুদ্ধের গতিপথ বদলে দিতে পারত, কারণ বর্বরিকের অসীম শক্তি যে পক্ষের সঙ্গে থাকত, বিজয় তারই নিশ্চিত ছিল।

শ্রীকৃষ্ণের পরীক্ষা এবং মহান মস্তক দান

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জানতেন যে বর্বরিকের শক্তি অনন্য। যদি তিনি হেরে যাওয়া পক্ষে যোগ দিতেন, তবে কৌরবদের সঙ্গে তাঁর যোগদান যুদ্ধের রূপ বদলে দিত। এই কারণেই শ্রীকৃষ্ণ একটি পরিকল্পনা করলেন। তিনি ব্রাহ্মণের বেশে বর্বরিকের কাছে পৌঁছলেন এবং তাঁর কাছে দান চাইলেন।

বর্বরিক বীরত্ব এবং প্রতিশ্রুতি পালনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বললেন যে তিনি যা চাইবেন, তাই দেবেন। তাঁর পরীক্ষা নিতে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর কাছে তাঁর মস্তকই চাইলেন। এটি শুনেও বর্বরিক বিচলিত হলেন না। তিনি বিনা দ্বিধায় নিজের মাথা কেটে শ্রীকৃষ্ণের চরণে সমর্পণ করলেন।

এই ত্যাগ ভারতীয় ধর্মীয় ঐতিহ্যে অনন্য বলে বিবেচিত হয়। তাই তাঁকে 'শীষ দানবীর' বলা হয়েছে।

যুদ্ধের সাক্ষী হওয়ার ইচ্ছা এবং শ্যাম রূপের বরদান

মস্তক দান করার পর বর্বরিক শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করলেন যে তিনি মহাভারতের পুরো যুদ্ধ দেখতে চান। কৃষ্ণ তাঁর ইচ্ছা পূরণ করলেন। বর্বরিকের মস্তক একটি উঁচু টিলায় স্থাপন করা হলো এবং তিনি যুদ্ধের প্রতিটি মুহূর্ত দেখলেন।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন যে তাঁর কাছে কার বীরত্ব সবচেয়ে বেশি মনে হয়েছে। বর্বরিক উত্তর দিলেন যে যুদ্ধে আসল শক্তি তো শ্রীকৃষ্ণেরই ছিল, তিনিই সবকিছু পরিচালনা করছিলেন। এটি শুনে শ্রীকৃষ্ণ প্রসন্ন হলেন।

তিনি বর্বরিককে আশীর্বাদ দিলেন যে কলিযুগে তিনি শ্যাম নামে পূজিত হবেন। শ্যাম, শ্রীকৃষ্ণেরই একটি নাম এবং এর অর্থ হলো সুন্দর, শীতল ও কল্যাণকারী। শ্রীকৃষ্ণ এও বললেন যে তিনি হেরে যাওয়া এবং হতাশ মানুষদের প্রথম আশা হবেন। যে কেউ সত্য মনে তাঁকে ডাকবে, তার দুঃখ দূর হবে এবং তার জীবনতরী পার হবে। এইভাবে বর্বরিক খাটু শ্যাম নামে বিখ্যাত হলেন।

আজও আস্থার কেন্দ্র

সিকর জেলার খাটু শহরে অবস্থিত মন্দিরটি আজও ভক্তদের ভিড়ে পরিপূর্ণ থাকে। ফাল্গুন মেলার সময় লক্ষ লক্ষ ভক্ত এখানে দর্শন করতে আসেন। মন্দিরের পরিবেশ ভক্তি ও শ্রদ্ধার অনুভূতিতে ভরে ওঠে। মন্দির প্রাঙ্গণে শ্যাম বাবার মস্তক রাখা আছে বলে বিশ্বাস করা হয় এবং ভক্তরা তার দর্শন করে মনস্কামনা জানান।

শ্যাম তেরি বাউরি, শ্যাম কুণ্ড এবং বড় বড় উৎসব এখানকার পরিচয়। অনেক ভক্তের বিশ্বাস যে খাটু শ্যামের দরবার থেকে কেউ খালি হাতে ফেরে না।

আস্থা এবং শিক্ষা

খাটু শ্যামের কাহিনী কেবল ধর্মীয় গুরুত্বই রাখে না, এটি নিষ্ঠা, ত্যাগ এবং ধর্ম পালনের বার্তাও দেয়। বর্বরিকের ত্যাগ এটি প্রমাণ করে যে প্রকৃত ধর্ম কেবল শক্তি নয়, বরং কর্তব্য এবং বিনম্রতার মধ্যেও নিহিত।

খাটু শ্যামের আশীর্বাদ এবং তাঁর করুণা আজও মানুষের আশার ভিত্তি। জীবনে যখন কঠিন সময় আসে, তখন বিশ্বাস, ধৈর্য এবং ভক্তিই মনকে শক্তি জোগায়। এই কারণেই খাটু শ্যামকে 'হেরে যাওয়াদের আশ্রয়' বলা হয়।

Leave a comment