খাটু শ্যাম মন্দিরের প্রতিমার রং পরিবর্তনের রহস্য: ভক্তদের বিশ্বাস ও প্রথা

খাটু শ্যাম মন্দিরের প্রতিমার রং পরিবর্তনের রহস্য: ভক্তদের বিশ্বাস ও প্রথা

রাজস্থানের সিকর জেলায় অবস্থিত, খাটু শ্যাম মন্দির শুধু একটি ধর্মীয় স্থান নয়, বরং কোটি কোটি ভক্তের আস্থার কেন্দ্র। মহাভারতের বীর যোদ্ধা, বর্বরিককে উৎসর্গীকৃত এই ধাম প্রতি বছর দেশ-বিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রীকে আকর্ষণ করে। কথিত আছে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বর্বরিককে কলিযুগে তাঁর 'শ্যাম' নামে পূজিত হওয়ার বরদান দিয়েছিলেন। সেই থেকেই এই স্থান খাটু শ্যাম ধাম নামে পরিচিত এবং এখানে অধিষ্ঠিত প্রতিমাকে শ্যাম বাবার রূপেও পূজা করা হয়।

আসল কি প্রতিমার রং বদলায়?

খাটু শ্যাম মন্দিরে স্থাপিত বাবার প্রতিমাকে নিয়ে ভক্তদের মধ্যে বহু বছর ধরে একটি কৌতূহলোদ্দীপক আলোচনা চলে আসছে। শোনা যায়, এই প্রতিমার রং প্রতি মাসে বদলায় — কখনও হালকা, কখনও গাঢ় কালো। এই বিষয়টি যেমন রহস্যজনক, তেমনই ভক্তদের বিশ্বাসকে গভীরতা দেয়। তবে এই পরিবর্তনের পেছনে কোনো অলৌকিক ঘটনা বা কোনো রহস্যময় শক্তি নেই, বরং এটি মন্দিরের প্রাচীন প্রথা এবং বিশেষ অলংকরণের একটি অংশ।

কৃষ্ণপক্ষে শ্যাম বর্ণ, শুক্লপক্ষে শালগ্রাম রূপ

মন্দির প্রশাসন এবং স্থানীয় পুরোহিতদের মতে, খাটু শ্যামের প্রতিমার রং দুটি রূপে দেখা যায়। যখন কৃষ্ণপক্ষ (অন্ধকার পক্ষ) চলে, তখন বাবাকে শ্যাম বর্ণ অর্থাৎ হালকা হলুদ-সাদা রঙে সাজানো হয়। এই সময় প্রতিমাকে চন্দন, আবির এবং অন্যান্য বিশেষ সাজসজ্জা সামগ্রী দিয়ে সজ্জিত করা হয়, যা বাবার রং সোনালী-সাদা দেখায়।

অন্যদিকে, যখন শুক্লপক্ষ (আলোর পক্ষ) আসে, তখন বাবাকে শালগ্রাম রূপে সাজানো হয়। এই রূপে, প্রতিমার উপর গাঢ় রঙের দ্রব্য দিয়ে অভিষেক করা হয় এবং কালো বস্ত্র ও অলঙ্কার দিয়ে সাজানো হয়। শালগ্রাম রূপে বাবার রং গাঢ় কালো দেখায়, যা তাঁর তান্ত্রিক রূপ হিসেবেও পরিচিত।

অমাবস্যায় বিশেষ অভিষেক

মন্দিরের প্রথা অনুসারে, অমাবস্যার দিন বাবা শ্যামের বিশেষ অভিষেক হয়। এই দিনে দুধ, দই, মধু, ঘৃত এবং সুগন্ধী দ্রব্য দিয়ে তাঁকে স্নান করানো হয়। এই অভিষেকের পর, প্রতিমা তাঁর আসল রূপে অর্থাৎ শ্যাম বর্ণে ফিরে আসে। এই প্রক্রিয়াটি কেবল ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করা হয় না, বরং এর মাধ্যমে ভক্তরা বাবার উভয় রূপ দর্শনের সৌভাগ্য লাভ করেন।

২৩ দিন শ্যাম রূপে, ৭ দিন শালগ্রাম রূপে

মন্দিরের নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি মাসে বাবার প্রতিমা প্রায় ২৩ দিন শ্যাম বর্ণ অর্থাৎ হালকা হলুদ রূপে থাকে, যেখানে অবশিষ্ট ৭ দিন তাঁকে শালগ্রাম রূপে সাজানো হয়। এই ব্যবস্থা কোনো বৈজ্ঞানিক অলৌকিকতার কারণে নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় বিধি ও প্রথা অনুসারে হয়ে থাকে। ভক্তদের জন্য এই পরিবর্তন একটি রহস্য হতে পারে, তবে মন্দিরের জন্য এটি প্রতিদিনের আরাধনার একটি অংশ।

সাজসজ্জার রীতিতে রূপের পরিবর্তন

খাটু শ্যাম মন্দিরে সাজসজ্জাকে অত্যন্ত পবিত্র এবং বিধিসম্মত কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাবার সাজসজ্জা প্রতিদিন বদলায় এবং কোন দিন কোন রূপ দেখানো হবে সে বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়। রং, বস্ত্র, ফুল, চন্দন এবং সুগন্ধি দিয়ে বাবার এমনভাবে সাজসজ্জা করা হয় যে প্রতিমার রূপটাই আলাদা মনে হয়। এই সাজসজ্জা পদ্ধতির কারণেই শ্যাম বাবার রংও ভক্তদের কাছে পরিবর্তনশীল মনে হয়।

ভক্তদের জন্য এই অভিজ্ঞতা অলৌকিক

যদিও মন্দির প্রশাসন এই পরিবর্তনকে সাজসজ্জা প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মনে করে, তবে ভক্তদের অনুভূতি এর চেয়ে অনেক বেশি গভীর। অনেক ভক্ত বিশ্বাস করেন যে এই রং পরিবর্তন বাবার লীলা এবং এই অলৌকিক ঘটনা তাঁদের জীবনে শুভ বার্তা নিয়ে আসে। কিছু ভক্ত এটিকে বাবার মেজাজ এবং ভক্তদের কষ্ট নিজের উপর নেওয়ার ইঙ্গিত হিসেবেও দেখেন।

অনেক ভক্ত এই দিনগুলিতে বিশেষ দর্শন করেন

যে সকল ভক্ত বাবা শ্যামের উভয় রূপ দর্শন করতে চান, তাঁরা মন্দির পরিদর্শনের সময়ও সেই অনুযায়ী নির্ধারণ করেন। অনেক ভক্ত শুক্লপক্ষের দিনগুলিতে দর্শন করতে আসেন, যাতে বাবার কালো শালগ্রাম রূপ দেখতে পারেন। আবার কিছু ভক্ত কৃষ্ণপক্ষে এসে বাবার সৌম্য শ্যাম বর্ণ রূপের দর্শন করতে পছন্দ করেন। এটি থেকে স্পষ্ট হয় যে প্রতিমার রং পরিবর্তনের এই প্রথা ভক্তদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

শতবর্ষ পুরনো প্রথা আজও বিদ্যমান

মনে করা হয়, এই প্রথা শত শত বছর ধরে চলে আসছে এবং আজও এটি আগের মতোই শ্রদ্ধা ও নিয়মের সাথে পালন করা হয়। মন্দিরের পুরোহিত ও সেবকরা এই প্রথাকে জীবিত রাখার জন্য বিশেষ যত্ন নেন। এই কারণেই আজও খাটু শ্যাম মন্দির তার স্বাতন্ত্র্য এবং আস্থার জন্য বিখ্যাত।

খাটু শ্যাম: শুধু মন্দির নয়, একটি জীবন্ত বিশ্বাস

প্রতিমার রঙের পরিবর্তন কেবল একটি দৃশ্যমান পরিবর্তন নয়, বরং ভক্তদের অনুভূতি ও বিশ্বাসের প্রতিবিম্ব। খাটু শ্যামের এই মন্দিরে শুধু দর্শন হয় না, বরং অনুভূতির আদান-প্রদানও ঘটে। প্রতিটি রং, প্রতিটি রূপ, প্রতিটি সাজসজ্জা - সবই বাবার লীলার অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়, যা দেখার, বোঝার এবং অনুভব করার জন্য লক্ষ লক্ষ ভক্ত প্রতি বছর এই পবিত্র ধামে যাত্রা করেন।

Leave a comment