মহারাজা গঙ্গা সিং: রাজস্থানের ভাগীরথ

মহারাজা গঙ্গা সিং: রাজস্থানের ভাগীরথ

রাজস্থানের তপ্ত মরুভূমির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এমন একটি নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করা আছে, যিনি কেবল নিজের রাজ্যকে আধুনিকতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাননি, বরং ভারতকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে গর্বের সাথে উপস্থাপন করেছেন। এই নাম—মহারাজা গঙ্গা সিং। ১৩ই অক্টোবর ১৮৮০ সালে বিকানিরে জন্মগ্রহণকারী গঙ্গা সিং কেবল বীর যোদ্ধা ছিলেন না, বরং দূরদর্শী প্রশাসক, সমাজ সংস্কারক এবং সুদক্ষ কূটনীতিবিদও ছিলেন। তাঁকে 'রাজস্থানের ভাগীরথ' বলা হয়, আর এই উপাধি এমনি এমনি জোটেনি।

প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা: ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয়

মহারাজা গঙ্গা সিং মহারাজ লাল সিং-এর তৃতীয় সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকেই তাঁর মধ্যে নেতৃত্ব এবং অনুশাসনের ছাপ দেখা যেত। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা গোয়ালিয়রে এবং পরে আজমিরের বিখ্যাত মেয়ো কলেজে লাভ করেন। এই শিক্ষা কেবল পাঠ্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তিনি রাজকার্য, সামরিক কৌশল এবং আধুনিক প্রশাসনের বিভিন্ন দিকগুলিও গুরুত্বের সঙ্গে শিখেছিলেন। তাঁর সামরিক প্রশিক্ষণ দেওলি রেজিমেন্টে হয়, যেখানে তিনি ব্রিটিশ সামরিক অনুশাসন সম্পর্কেও পরিচিত হন।

বিকানেরের যুবরাজ থেকে মহারাজা হওয়া পর্যন্ত

১৮৮৭ সালে তাঁর বড় ভাই ডুঙ্গার সিং-এর মৃত্যুর পর মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি বিকানির রাজ্যের রাজা হন। প্রথমে রাজ্য পরিচালনা একটি পরিষদের অধীনে ছিল, কিন্তু ১৮৯৮ সালে সাবালক হওয়ার পরে গঙ্গা সিং স্বয়ং শাসনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এর পরে বিকানির যে দ্রুত গতিতে উন্নতির পথে এগিয়ে যায়, তা সমগ্র ভারতের জন্য এক অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়।

গঙ্গা খাল: মরুভূমিতে বয়ে চলা জীবনধারা

গঙ্গা সিং-এর সবচেয়ে বড় অবদান ছিল গঙ্গা খাল প্রকল্প, যা রাজস্থানের শুষ্ক মরুভূমিকে সবুজ-শ্যামল ক্ষেতে পরিণত করে। পাঞ্জাবের শতদ্রু নদী থেকে জল এনে বিকানির এবং শ্রীগঙ্গানগর অঞ্চলকে সেচের আওতায় আনার এই পরিকল্পনা কেবল প্রযুক্তিগত দিক থেকেই জটিল ছিল না, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও বিপ্লবী ছিল। হাজার হাজার কৃষক পরিবার এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে এবং এই ভূমিকে উর্বর করে তোলে। এই কারণেই তাঁকে 'রাজস্থানের ভাগীরথ' বলা হত।

একজন সুদক্ষ প্রশাসক: ন্যায়বিচার, শিক্ষা এবং জনকল্যাণ

মহারাজা গঙ্গা সিং কেবল ভৌত উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং সামাজিক ও বিচার বিভাগীয় সংস্কারেরও সূচনা করেন। তিনি বিকানিরে উচ্চ আদালতের প্রতিষ্ঠা করেন, যা কোনো রাজ্যের জন্য এক নতুন পদক্ষেপ ছিল। ১৯১৩ সালে তিনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সভা গঠন করেন এবং পরে ব্যবস্থাপক সভায় (Legislative Assembly) পরিবর্তন করেন। তিনি তাঁর রাজ্যে বাল্যবিবাহ বন্ধ করার জন্য শারদা আইন কঠোরভাবে কার্যকর করেন, মহিলাদের জন্য স্কুল-কলেজ খোলেন, সরকারি কর্মচারীদের জন্য জীবন বীমা প্রকল্প চালু করেন এবং ব্যাংকগুলিকে জনগণের জন্য সহজলভ্য করেন।

সামরিক নেতৃত্ব এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ

গঙ্গা সিং কেবল একজন রাজা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন পরাক্রমী সামরিক নেতাও। তিনি ‘গঙ্গা রিসালা’ নামে উটের একটি সেনা দল গঠন করেন এবং ব্রিটিশ ফৌজের হয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্স, মিশর ও প্যালেস্টাইনে যুদ্ধ করেন। তাঁর অবদান এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তাঁকে ‘ব্রিটিশ ইম্পেরিয়াল ওয়ার ক্যাবিনেট’-এর সদস্য করে—এই কমিটিতে যোগ দেওয়া প্রথম এবং একমাত্র ভারতীয় ছিলেন তিনি।

আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের কণ্ঠস্বর

১৯১৯ সালে অনুষ্ঠিত প্যারিস শান্তি সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্বকারী গঙ্গা সিং ছিলেন একমাত্র ভারতীয় রাজা যিনি ভার্সাইয়ের ঐতিহাসিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই যাত্রাপথে তিনি ‘রোম নোট’-এর মাধ্যমে ব্রিটিশদের কাছে ভারতকে স্থানীয় স্ব-শাসন দেওয়ার দাবি জানান, যা তাঁর দূরদর্শিতা ও দেশপ্রেমের পরিচয় বহন করে।

বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে অবদান ও সংস্কৃতি-প্রেম

গঙ্গা সিং-এর শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অবদানও কম উল্লেখযোগ্য ছিল না। তিনি বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে বেশি আর্থিক সাহায্য করেন। এই অবদানে প্রভাবিত হয়ে মহামনা মদন মোহন মালব্য তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর বানান। তিনি ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত এই পদে ছিলেন। করণী মাতা মন্দির, রামদেওরা মন্দির, এবং লালগড় প্যালেসের মতো স্থাপত্যকর্ম তাঁর সাংস্কৃতিক সৌন্দর্যবোধের প্রতীক।

অন্তিম সময় ও উত্তরাধিকার

২রা ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ সালে বোম্বেতে তাঁর মৃত্যু হয়, কিন্তু তাঁর স্মৃতি আজও শ্রীগঙ্গানগর, বিকানির এবং রাজস্থানের আনাচে-কানাচে জীবিত। গঙ্গা সিং প্রমাণ করেছিলেন যে একজন রাজা কেবল মুকুট ও সিংহাসনের রক্ষক নন, বরং তিনি তাঁর প্রজার পিতা, পথপ্রদর্শক এবং সেবকও হন।

মহারাজা গঙ্গা সিং-এর জীবন একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক, দূরদর্শী প্রশাসক এবং জনসেবকের এক অসাধারণ উদাহরণ। তিনি বিকানিরকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর করা সামাজিক, বিচার বিভাগীয় ও সেচ সংস্কার আজও অনুপ্রেরণার উৎস। বাস্তবিকই, তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।

Leave a comment