আমাদের সনাতন ধর্মে, প্রত্যেক দেবী-দেবতার পূজা-পদ্ধতি ভিন্ন। যেমন মা দুর্গার সৌন্দর্য ও সাজসজ্জা পছন্দ, তেমনই ভগবান শিবের ভালো লাগে ভস্ম এবং বেলপাতা। একইভাবে, হনুমানজির আরাধনাও নির্দিষ্ট কিছু নিয়মের সঙ্গে জড়িত। বিশেষ করে মহিলাদের হনুমানজির মূর্তির চরণ স্পর্শ থেকে কেন দূরে রাখা হয়, এটি এমন একটি বিষয় যা প্রায়ই কৌতূহল জাগায়। এটি কোনো রক্ষণশীল ধারণা নয়, বরং এর পিছনে গভীর ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ভাবনা রয়েছে, যা জানা অপরিহার্য।
হনুমানজি: আদর্শ ব্রহ্মচারী এবং নিবেদিত সেবক
হনুমানজি রাম ভক্ত, সংকট মোচন, এবং অষ্ট সিদ্ধিদাতারূপে পরিচিত। তিনি ভগবান শিবের একাদশ রুদ্র অবতার হিসাবে গণ্য হন এবং রামকথায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন বাল ব্রহ্মচারী এবং সারা জীবন ব্রহ্মচর্য পালন করেছেন। তাঁর চরিত্র সংযম, ভক্তি এবং সেবার প্রতীক।
হনুমানজি জীবনে কোনো নারীর প্রতি কামনার দৃষ্টিতে তাকাননি। তিনি মা সীতাকে মায়ের স্থান দিয়েছেন। রামায়ণে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, অশোকবনে যখন হনুমানজি মা সীতার সঙ্গে দেখা করতে যান, তখন তিনি তাঁকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেন।
মহিলারা কেন হনুমানজির পা স্পর্শ করেন না?
এই ধারণাটি কেবল কোনো প্রথার অংশ নয়, এটি একটি আধ্যাত্মিক মর্যাদা। এর পেছনের প্রধান কারণগুলো জেনে নিন:
১. ব্রহ্মচর্য্যের মর্যাদা: হনুমানজি একজন আদর্শ ব্রহ্মচারী। তিনি নারী থেকে মানসিক, শারীরিক ও ব্যবহারিক দূরত্ব বজায় রেখেছেন। এমন পরিস্থিতিতে, তাঁর পূজা করার সময় কোনো নারীর মূর্তিকে স্পর্শ করা, তাঁর চরণ স্পর্শ করা, ব্রহ্মচর্য্যের মর্যাদাকে লঙ্ঘন করার মতো।
২. মাতৃত্বের প্রতি সম্মান: হনুমানজি সকল নারীকে মায়ের স্থান দিয়েছেন। যেমন পুত্র তার মায়ের চরণ স্পর্শ করে না, তেমনই তিনি চান না যে নারীরা তাঁর চরণ স্পর্শ করুক। এটি মাতৃভাবের প্রতি সম্মানের প্রতীক।
৩. বিনম্র প্রণাম-এর বিধান: মহিলাদের জন্য বলা হয়েছে যে, তাঁরা যেন হনুমানজির চরণ স্পর্শ না করেন, তবে হাত জোড় করে, ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে, চালিশা পাঠ করে এবং ফুল অর্পণ করে তাঁর পূজা করতে পারেন। এটিও সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা ও ভক্তির প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয়।
মহিলারা কি হনুমানজির পূজা করতে পারেন?
হ্যাঁ, মহিলারা হনুমানজির পূজা করতে পারেন, তবে কিছু নিয়ম মেনে চলা জরুরি:
- তাঁরা হনুমান চালিশা, সুন্দরকাণ্ড, বজরং বাণ ইত্যাদি পাঠ করতে পারেন।
- হনমান মন্দিরে প্রবেশ করতে পারেন তবে মূর্তি স্পর্শ করবেন না।
- পূজা করার সময় শুদ্ধতা ও সংযম বজায় রাখুন।
- মাসিক ঋতুস্রাবের সময় পূজা করা থেকে বিরত থাকুন, কারণ এই সময়টি ধর্মীয় শুদ্ধতার মানদণ্ড অনুযায়ী উপযুক্ত বলে মনে করা হয় না।
মহিলাদের জন্য হনুমানজির ভক্তির উপকারিতা
যদিও মূর্তি স্পর্শ করা নিষিদ্ধ, তবে হনুমানজির ভক্তি করলে মহিলারাও অনেক উপকার পেতে পারেন:
- নकारात्मक শক্তি থেকে রক্ষা: হনুমানজি ভূত-প্রেত, নজর দোষ এবং খারাপ শক্তি থেকে রক্ষা করেন।
- সন্তান সুখের प्राप्ति: হনুমান চালিশা নিয়মিত পাঠ করলে মহিলাদের সন্তান সুখ পেতে সহায়তা করে।
- বাড়িতে শান্তি ও নিরাপত্তা: মহিলাদের প্রতিদিন হনুমান চালিশা পাঠ করলে বাড়িতে ইতিবাচক শক্তি বজায় থাকে।
জ্যোতিষ শাস্ত্র কী বলে?
জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুসারে, হনুমানজির পূজা শুক্রবার ও মঙ্গলবার করা বিশেষভাবে শুভ ও ফলদায়ক বলে মনে করা হয়। জ્યોতিষাচার্য ড. অরবিন্দ মিশ্র জানান যে মহিলারা হনুমানজির পূজা করতে পারেন, তবে মূর্তিকে স্পর্শ করার পরিবর্তে মন থেকে শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে পূজা করা উচিত। এটি করলে তাঁরাও আশীর্বাদ পান এবং ধর্মীয় মর্যাদা বজায় থাকে।
শ্রীরামের সেবক, সীতার পুত্রস্বরূপ
হনুমানজিকে ভগবান শ্রীরামের পরম ভক্ত এবং মা সীতার পুত্রস্বরূপ মনে করা হয়। তিনি মহিলাদের অত্যন্ত সম্মান করেন এবং চান যে কোনো মহিলা যেন তাঁর চরণে নত না হন। এই কারণে হনুমানজি স্বয়ং মহিলাদের সামনে সর্বদা বিনম্রভাবে মাথা নত করেন এবং তাঁদের শ্রদ্ধা ও আদরের সঙ্গে দেখেন। তাঁর এই আচরণ মর্যাদা, ভক্তি এবং সংস্কৃতির প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয়।
হনুমানজির পূজা এবং তাঁর চরণ স্পর্শের সঙ্গে জড়িত প্রথা শুধু ধর্মীয় অনুশাসন নয়, এটি একটি গভীর আধ্যাত্মিক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। তিনি মহিলাদের মায়ের মতো দেখেন এবং তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধার অনুভূতি রাখেন। তাই তাঁর পূজায় মর্যদা পালন করা স্বয়ং হনুমানজির অনুভূতির প্রতি সম্মান জানানো। ভক্তিতে অনুভূতিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, স্পর্শ নয়।