বাঙালির আপন হতে রাম নাম নয় এ বার কালী-দুর্গার উচ্চারণে মোদীর সভা

বাঙালির আপন হতে রাম নাম নয় এ বার কালী-দুর্গার উচ্চারণে মোদীর সভা

দুর্গাপুরে অনুষ্ঠিত সভায় সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে ধরা দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সভা শুরু হল ‘জয় মা কালী’, ‘জয় মা দুর্গা’ উচ্চারণে। এই দৃশ্য দেখে অনেকেই চমকে উঠেছেন। যেখানে এতদিন ‘জয় শ্রী রাম’ ছিল বিজেপির একমাত্র সাংস্কৃতিক চালিকাশক্তি, সেখানে হঠাৎ বাঙালির আরাধ্যা দেবীর নামে ভাষণ শুরু কেন? মোদীর গলায় রজনীগন্ধার মালা, হাতে পোড়ামাটির দুর্গামূর্তি—এই চিত্র যেন ইঙ্গিত দিচ্ছে, ‘বহিরাগত’ ইমেজ বদলে বাঙালি সংস্কৃতির আবহেই এবার ভোট-রাজনীতির নৌকা ভাসাতে চায় গেরুয়া শিবির।

বড়বাজার থেকে ধর্মতলায়: বদলে যাওয়া বিজেপি রাজনীতির ছক

স্মৃতিচারণে ফিরে যাওয়া যাক—এক সময় বিজেপিকে বলা হত ‘বড়বাজারের দল’। রাজ্যে সংগঠন বলতে কিছু ছিল না, ভোট শতাংশ ছিল হাতে গোনা। ১৯৯৮ সালে তৃণমূলের হাত ধরে দমদম থেকে প্রথম জয় আসে লোকসভায়। সেই বিজেপি এখন রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল। ভোটের হার ৪০ শতাংশ ছুঁয়েছে। কিন্তু এখনও বিজেপিকে বহু মানুষ ‘গোবলয়ের দল’ বলেই চিহ্নিত করেন। তৃণমূলও সেই দুর্বলতাকেই কাজে লাগিয়ে প্রচারে তুলেছিল ‘বহিরাগত বনাম বাংলার মেয়ে’-র তত্ত্ব। এবার তাই বিজেপির চেষ্টা, “বাঙালির ঘরের লোক” হয়ে ওঠা। রাজনৈতিক ভাষায়, ‘কল্পনা নয়, কৌশল’।

বাঙালি গন্ধ মঞ্চে: রাজনীতির নতুন প্রলেপে মোড়ানো ‘বাঙালিয়ানা’

মোদীর এই ‘বাঙালিপনা’ শুধুই আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং তা গভীর রাজনৈতিক বার্তা। দুর্গাপুরের সভায় তাঁকে মালা পরালেন শমীক ভট্টাচার্য। উপহার হিসেবে দিলেন পোড়ামাটির দুর্গামূর্তি। গলায় রজনীগন্ধা, পটভূমিতে বাংলার ঐতিহ্য—এই পুরো দৃশ্যপট যেন সাজানো হয়েছে অত্যন্ত সচেতনভাবে। মোদীর এই রূপের নেপথ্যে রয়েছে তৃণমূলের বহিরাগত প্রচারের পাল্টা উত্তর। এবার বিজেপি বুঝে গিয়েছে, বাংলায় শুধুমাত্র রামনামে কাজ হবে না। বাঙালির মনে পৌঁছতে গেলে বাংলার দুর্গা, বাংলার কালী—এই ভাষাতেই কথা বলতে হবে।

তৃণমূলের বিরুদ্ধে বাংলার ‘অস্মিতা’র লড়াইয়ের বার্তা

বাঙালিকে বাংলাদেশি বলে দেগে দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে তৃণমূল বহুদিন ধরেই বিজেপিকে আক্রমণ করছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে বৃষ্টিস্নাত রাজপথে নেমে প্রতিবাদ করেছেন। দিল্লির জয় হিন্দ কলোনি, রাজস্থানে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকের নিগ্রহ—তৃণমূল বারবার এই চিত্র তুলে ধরেছে। এই অভিযোগের জবাব দিতে গিয়েই মোদীর কণ্ঠে শোনা গেল, “বাংলার পরিচয়কে তৃণমূল বিপন্ন করছে। অনুপ্রবেশকারীদের ভুয়ো নথি তৈরি করে দিচ্ছে। বিজেপি বাংলার সংস্কৃতি রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।” রাজনৈতিকভাবে কড়া বার্তা, কিন্তু ছায়ায় রয়ে যাচ্ছে সাংস্কৃতিক ও আঞ্চলিক সম্মানবোধের তর্ক।

শ্যামাপ্রসাদ থেকে কাদম্বিনী: ভাষণে ‘বাংলা সংস্কৃতি’র উজ্জ্বল চিত্র

মোদীর ভাষণ কেবল সমকালীন রাজনীতি নয়, বাংলার অতীত গৌরবকেও আঁকড়ে ধরেছে। ভাষণে এসেছে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নাম—যাঁর ভাবনাতেই তৈরি বিজেপির ভিত্তি। কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, বিধানচন্দ্র রায়, বিষ্ণু দে—সবার নাম উচ্চারণ করে মোদী বুঝিয়ে দিলেন, তিনি বাংলা সংস্কৃতি ও কৃতিদের সম্মান করেন। বাংলা ভাষা বললেই কেউ ‘বাংলাদেশি’ হয় না—এই অভিযোগ ফুৎকারে উড়িয়ে তিনি বললেন, “আমরাই বাংলা ভাষাকে শাস্ত্রীয় ভাষার মর্যাদা দিয়েছি।” পাল্টা তুলে ধরলেন কংগ্রেস-বাম-তৃণমূলের যুগ্ম শাসনের সময়ে বাংলার ভাষার গুরুত্ব কীভাবে উপেক্ষিত ছিল।

বিজেপির সাংস্কৃতিক মেকওভার—রাজনৈতিক চাল নাকি প্রকৃত রূপান্তর?

বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে গেলে শুধু চটকদার স্লোগান নয়, প্রমাণ করতে হয় গ্রহণযোগ্যতা। এখন প্রশ্ন উঠছে, বিজেপির এই সংস্কৃতিমুখী রূপ প্রকৃত আন্তরিকতা নাকি কেবলমাত্র নির্বাচনী চিত্রনাট্যের নতুন পাতা? দুর্গাপুরের সভায় মোদীর কণ্ঠে বাংলার গর্ব, বাংলার দেবী, বাংলার সন্তানদের কথা উঠে এলেও—সমান্তরাল বাস্তবের প্রশ্নও প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে যখন একাধিক বিজেপি শাসিত রাজ্যে বাংলাভাষীদের নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তাই রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন—এই সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের নেপথ্যে রয়েছে ‘বহিরাগত’ ইমেজ ঝেড়ে ফেলার চূড়ান্ত প্রচেষ্টা।

Leave a comment