নাসা ও ইসরোর যৌথ উদ্যোগে নিসার স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ: এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ

নাসা ও ইসরোর যৌথ উদ্যোগে নিসার স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ: এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ

নাসা এবং ইসরো যৌথভাবে বিশ্বের প্রথম ডুয়াল রাডার স্যাটেলাইট 'NISAR' উৎক্ষেপণ করেছে। এই মিশন ভূমিকম্প, বন্যা, কৃষি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এর ডেটা বিজ্ঞানী ও কৃষকদের বিনামূল্যে দেওয়া হবে।

NISAR: ভারত ও আমেরিকার মহাকাশ সংস্থা, ইসরো ও নাসার যৌথ উদ্যোগে তৈরি হওয়া NISAR (NASA-ISRO Synthetic Aperture Radar) মিশন আজ একটি বড় মাইলফলক অর্জন করতে চলেছে। এই স্যাটেলাইটটি বুধবার সন্ধ্যা ৫:৪০ মিনিটে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হবে। এটি GSLV Mk-II রকেটের মাধ্যমে উৎক্ষেপণ করা হবে এবং স্যাটেলাইটটিকে সূর্য-সমলয় কক্ষপথে (Sun-Synchronous Orbit) স্থাপন করা হবে।

নিসার কী এবং কেন বিশেষ?

নিসার একটি পৃথিবী পর্যবেক্ষণকারী স্যাটেলাইট, যার ওজন প্রায় ২,৩৯২ কিলোগ্রাম। এটি বিশ্বের প্রথম স্যাটেলাইট যা দুটি রাডার ব্যান্ড—নাসার এল-ব্যান্ড এবং ইসরোর এস-ব্যান্ড—একসাথে ব্যবহার করে। এই বিশেষ প্রযুক্তি এটিকে পৃথিবীর পৃষ্ঠে হওয়া পরিবর্তনগুলি খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম করে। এর মূল্য প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ১২,৫০০ কোটি টাকা), যা এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল পৃথিবী পর্যবেক্ষণ মিশনগুলির মধ্যে একটি করে তুলেছে।

নিসারের প্রযুক্তিগত কাঠামো

এই মিশনটি তৈরি করতে প্রায় ১০ বছর লেগেছে। এতে একটি ১২ মিটার সোনার জালের অ্যান্টেনা লাগানো হয়েছে, যা নিম্ন পৃথিবীর কক্ষপথে (Low Earth Orbit) বৃহত্তম হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। স্যাটেলাইটটিকে ইসরোর I-3K বাসের সাথে যুক্ত করা হয়েছে, যেখানে কমান্ড, ডেটা, প্রোপালশন এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য সিস্টেম রয়েছে এবং ৪ কিলোওয়াট সৌর শক্তি সহায়তার ব্যবস্থা আছে।

কীভাবে নিসার কাজ করবে?

উৎক্ষেপণের পর নিসার স্যাটেলাইটটি ৭৪৭ কিলোমিটার উচ্চতায় সূর্য-সমলয় কক্ষপথে স্থাপন করা হবে। তবে, এটি অবিলম্বে ডেটা পাঠানো শুরু করবে না। প্রথম ৯০ দিন এটি কমিশনিং পর্যায়ে থাকবে, যেখানে সমস্ত সিস্টেমের পরীক্ষা এবং ক্রমাঙ্কন (calibration) করা হবে। এর পরেই এটি বৈজ্ঞানিক ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হবে।

ডুয়াল রাডার সিস্টেমের শক্তি

L-ব্যান্ড SAR (1.257 GHz): এটি দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রাডার যা ঘন জঙ্গল এবং মাটির নীচের গতিবিধিও পরিমাপ করতে পারে। এর দ্বারা ভূমি গঠনের সূক্ষ্ম পরিবর্তনও বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

S-ব্যান্ড SAR (3.2 GHz): এটি ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রাডার, যা ভূপৃষ্ঠের খুঁটিনাটি যেমন ফসল, জলের উৎস এবং শহুরে এলাকা বিস্তারিতভাবে দেখতে পারে।

SweepSAR প্রযুক্তির মাধ্যমে বিস্তারিত কভারেজ

নিসার প্রথমবার SweepSAR প্রযুক্তি ব্যবহার করবে, যার ফলে এটি প্রতি ১২ দিনে পুরো পৃথিবী স্ক্যান করতে পারবে। এই প্রযুক্তি ২৪২ কিলোমিটারের মধ্যে উচ্চ মানের ডেটা সরবরাহ করবে। বিশেষ বিষয় হল এই স্যাটেলাইট মেঘ, অন্ধকার এবং আবহাওয়ার পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হবে না। দিন-রাত সব পরিস্থিতিতে এটি পৃথিবীর সঠিক ছবি তুলতে পারবে।

কোন ক্ষেত্রে নিসার উপযোগী হবে?

  • ভূমিকম্প এবং আগ্নেয়গিরির পর্যবেক্ষণ: নিসার সেই অঞ্চলগুলিতে ভূমিকম্পীয় কার্যকলাপ পরিমাপ করবে যেগুলি বেশি সংবেদনশীল বলে মনে করা হয়, যেমন হিমালয় অঞ্চল।
  • বন্যা এবং ভূমিধসের ওপর নজর: আবহাওয়া সংক্রান্ত দুর্যোগের দ্রুত তথ্য দিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থাগুলিকে সময় মতো ব্যবস্থা নিতে সাহায্য করবে।
  • কৃষিতে সহায়তা: কৃষকরা মাটির আর্দ্রতা, ফসলের অবস্থা এবং সম্ভাব্য ক্ষতির পূর্বাভাস পাবেন, যার ফলে তারা আরও ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
  • বন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের পর্যবেক্ষণ: এই স্যাটেলাইট বনভূমি ধ্বংস, বরফের স্তরের পরিবর্তন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি-সহ জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত ঘটনাগুলির ওপরও নজর রাখবে।

এই মিশন থেকে প্রাপ্ত ডেটা বিজ্ঞানী, নীতিনির্ধারক, কৃষি বিশেষজ্ঞ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইউনিটগুলিকে বিনামূল্যে সরবরাহ করা হবে। বিশেষ বিষয় হল, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিস্থিতিতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এই ডেটা পাওয়া যাবে, যা জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করতে সহায়ক হবে।

Leave a comment