সংকটকালে নেপালের সেনাপ্রধানের ভূমিকা এবং ভারত-নেপাল সামরিক ঐতিহ্যের গভীরতা

সংকটকালে নেপালের সেনাপ্রধানের ভূমিকা এবং ভারত-নেপাল সামরিক ঐতিহ্যের গভীরতা
সর্বশেষ আপডেট: 3 ঘণ্টা আগে

নেপালে সেনাপ্রধান জেনারেল অশোক রাজ সিগদেল সংকটকালে শান্তি বজায় রেখেছেন। নেপালী সেনাবাহিনীর ইতিহাস গোর্খা ঐতিহ্য এবং ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্কের সাথে যুক্ত।

Nepal: নেপালে রাজনৈতিক সংকট ক্রমশ বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির পদত্যাগের পর নেপালী সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। এই মুহূর্তে নেপালী সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল অশোক রাজ সিগদেল সংকটকালে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। তাঁর নেতৃত্বে নেপাল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে অগ্রসর হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

জেনারেল অশোক রাজ সিগদেলের সাথে ভারতের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তিনি ভারতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা কোর্স করেছেন এবং ২০২৪ সালে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু তাঁকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেলের সম্মানসূচক পদ প্রদান করেন। এই সম্মান ভারত ও নেপালের মধ্যে ঐতিহাসিক সামরিক সম্পর্কের প্রতীক এবং দুই দেশের মধ্যে সাত দশক ধরে চলে আসা ঐতিহ্যের প্রতিফলন।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় নেপালী সেনাবাহিনীর ভূমিকা

নেপাল বর্তমানে তার ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুতর রাজনৈতিক সংকটের সম্মুখীন। প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির পদত্যাগের পর সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। এই মুহূর্তে জনগণ ও সরকারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা সেনাবাহিনীর দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সূত্রমতে, জেনারেল সিগদেলই Gen-Z বিক্ষোভের সময় প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, যাতে সহিংসতা ও প্রাণহানি এড়ানো যায়।

তাঁর ভূমিকা কেবল প্রশাসনিক নয়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। নতুন সরকার গঠনেও তাঁর ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। নেপালী সেনাবাহিনীর কৌশল এবং নেতৃত্ব এই মুহূর্তে দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে নির্ধারক প্রমাণিত হচ্ছে।

ভারত-নেপালের সামরিক সম্পর্কের ইতিহাস

ভারত ও নেপালের মধ্যে গভীর এবং ঐতিহাসিক সামরিক সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্ক কেবল সহযোগিতার প্রতীক নয়, বরং ভাগ করে নেওয়া সম্মানেরও প্রতীক। দুই দেশের সেনাপ্রধানদের সম্মানসূচক পদ দিয়ে সম্মানিত করা হয়। এই প্রথার সূচনা ১৯৫০ সালে ভারতীয় সেনাপ্রধান কেএম কারিয়াপ্পার সময় হয়েছিল। সাত দশক ধরে এই প্রথা অব্যাহত রয়েছে।

গত বছর, রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু নেপালী সেনাপ্রধান জেনারেল অশোক রাজ সিগদেলকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেলের সম্মানসূচক পদ প্রদান করেন। এই সম্মান দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা এবং পারস্পরিক আস্থার প্রতীক।

নেপালী সেনাবাহিনীর গৌরবময় ইতিহাস

নেপালী সেনাবাহিনীর ইতিহাস ১৭০০ এর দশক পর্যন্ত বিস্তৃত। সেই সময় নেপাল বহু রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় উপমহাদেশে বিস্তার লাভ করছিল। নেপালও হুমকির মুখে ছিল। গোর্খা রাজ্যের রাজা পৃথ্বীনারায়ণ শাহ নেপালকে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তাঁর সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও একটি সুসংগঠিত ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করেন।

১৭৪০ সালে শুরু হওয়া এই অভিযান আধুনিক নেপালের ভিত্তি স্থাপন করে। গোর্খালি সৈন্যদের বীরত্ব ও সাংগঠনিক ক্ষমতা তাদের আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাতি এনে দেয়। যুদ্ধে তাদের দক্ষ কৌশল ও বীরত্ব ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকেও প্রভাবিত করেছিল। গোর্খা সৈন্যদের কারণে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী তাদের নিয়োগে অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করে। এইভাবে 'গোর্খা' নামটি নেপালী সেনাবাহিনীর বিশ্বব্যাপী পরিচিতি তৈরি করে।

নেপালী সেনাবাহিনীর স্বাধীনতা

অনেকের মনে ভুল ধারণা থাকে যে নেপালী সেনাবাহিনী ব্রিটিশ বা ভারতীয় সেনাবাহিনীর অংশ। এটি ভুল। নেপালী সেনাবাহিনী সার্বভৌম ও স্বাধীন নেপালের জাতীয় সেনাবাহিনী। এর ইতিহাস ১৭৪৪ সাল থেকে নিরবচ্ছিন্ন। নেপাল কখনো কোনো ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনে ছিল না। এই স্বাধীনতা নেপালী সেনাবাহিনীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন।

রাজা পৃথ্বীনারায়ণ শাহ যে কঠিন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী গঠন করেছিলেন, তার উদ্দেশ্য কেবল সামরিক শক্তি নয়, বরং জাতীয় ঐক্য ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ছিল। গোর্খা সৈন্যদের বীরত্ব ও সরলতা আজও নেপালে গর্বের প্রতীক।

নেপালী সেনাবাহিনীর প্রতীক

নেপালী সেনাবাহিনীর পতাকায় ভগবান শিবের ত্রিশূল ও ডমরু অঙ্কিত রয়েছে। এই প্রতীক কেবল ধর্মীয় নয়, বরং সেনাবাহিনীর শক্তি ও দৃঢ় সংকল্পেরও প্রতীক। নেপালের হিন্দু ঐতিহ্যের সাথে এই সামরিক প্রতীক ভারত থেকে সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিকভাবে যুক্ত। সেনাবাহিনীর এই প্রতীক নেপালী সেনাবাহিনীর পরিচয় ও গৌরব তুলে ধরে।

ত্রিশূল ও ডমরু প্রতীক নির্দেশ করে যে নেপালী সেনাবাহিনী কেবল যুদ্ধকলায় পারদর্শী নয়, বরং নৈতিকতা, সম্মান এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বজায় রাখাতেও বিশ্বাসী।

ভারত ও নেপালের যৌথ সামরিক ঐতিহ্য

ভারত ও নেপালের মধ্যে যৌথ সামরিক ঐতিহ্য সাত দশকেরও বেশি পুরানো। দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রশিক্ষণ, সম্মান ও আদান-প্রদানের প্রথা আজও অব্যাহত রয়েছে। এই সম্পর্ক দুই দেশের মধ্যে আস্থা ও সহযোগিতা জোরদার করে।

নেপালী সেনাবাহিনী এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে এই ঘনিষ্ঠতা কেবল সামরিক সহযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর মধ্যে মানবসম্পদ, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, যুদ্ধকলা এবং নেতৃত্ব বিকাশও অন্তর্ভুক্ত। এই অংশীদারিত্বের ফলে দুই দেশের সেনাবাহিনী কৌশলগত ও প্রযুক্তিগত সুবিধা লাভ করে।

Leave a comment