আবারও বাংলার বুক থেকে পাকিস্তানে গোপন তথ্য পাচারের চাঞ্চল্যকর ঘটনা! পূর্ব বর্ধমানের মেমারির মতো তুলনামূলক নিরীহ শহর হয়ে উঠেছিল আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কেন্দ্রবিন্দু। প্রি-অ্যাক্টিভেটেড সিম কার্ডের মাধ্যমে দেশের সেনা ঘাঁটির তথ্য পাচার করা হচ্ছিল বলে অভিযোগ। ধৃত দুই ব্যক্তি, রাকেশ কুমার গুপ্তা ও মুকেশ রজক — আদতে কলকাতার বাসিন্দা হলেও বর্ধমানে ঘর ভাড়া নিয়ে লুকিয়ে ছিল। পুলিশি জালে ধরা পড়তেই উন্মোচিত হল ভয়ানক ষড়যন্ত্র।
বিরাটির পর এবার মেমারি! একের পর এক ধরা পড়ছে জাল সিম চক্রের গুঁতো
উত্তর ২৪ পরগনার বিরাটিতে এমন চক্র প্রথম ধরা পড়ার পর রাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। এবার সেই সূত্র ধরেই মেমারিতে অভিযান চালিয়ে ধরা হয় আরও দুই চক্র সদস্যকে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, অভিযুক্তরা ভুয়ো নথির সাহায্যে অসংখ্য মোবাইল সিম সংগ্রহ করত। সেই সিমগুলি পৌঁছে যেত দিল্লি ও মুম্বইয়ের এজেন্টদের হাতে। এজেন্টরা OTP-এর মাধ্যমে সেগুলি অ্যাক্টিভেট করে পাকিস্তানের আইএসআইয়ের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ তৈরি করত। ওয়াটসঅ্যাপ ও অন্যান্য এনক্রিপ্টেড অ্যাপেই চলত ‘গোপন বার্তা’র আদান-প্রদান।
নাটকীয় মোড়! পুলিশি তল্লাশির আঁচ পেয়ে নার্সিংহোমে আশ্রয় মুকেশের
পুলিশি অভিযান বুঝতে পেরে ঘাঁটি ছেড়ে পালানোর চেষ্টায় ছিলেন অভিযুক্ত মুকেশ। শেষমেশ আশ্রয় নেন মেমারির পাওয়ার হাউস এলাকার এক বেসরকারি নার্সিংহোমে। নিজেকে রোগী বলে পরিচয় দিয়ে ভর্তি হন। তবে এই ছকও ধরে ফেলেন এসটিএফ-এর অফিসাররা। রাকেশকে জেরা করে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নার্সিংহোমে হানা দিয়ে মেডিক্যাল রিপোর্ট যাচাইয়ের পরে সেখান থেকেই গ্রেফতার করা হয় মুকেশকে। গোটা ঘটনার নাটকীয়তা চিত্রনাট্যের মতো।
টাকার বিনিময়ে অপারেশন সিঁদুর! সেনা ছাউনির তথ্য পৌঁছত আইএসআই-এর হাতে
পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছে আরও ভয়ঙ্কর তথ্য। অভিযুক্তদের মূল লক্ষ্য ছিল দেশের সেনা ঘাঁটি থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তা পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর কাছে পাচার করা। পানাগড় সেনা ছাউনি ছিল তাদের মূল নিশানা। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের ‘অপারেশন সিঁদুর’ চলাকালীনও ওই দুই অভিযুক্ত সক্রিয়ভাবে কাজ করেছিল বলে সন্দেহ। তারা নিয়মিতভাবে পাকিস্তান থেকে আসা বার্তার ভিত্তিতে তথ্য জোগাড় করে পাঠাত, আর তার বিনিময়ে হাতিয়ে নিত মোটা টাকা।
এনজিও-র ছদ্মবেশে কোটি টাকার লেনদেন! তিন বছর ধরে চলেছে ছায়া-চক্র
তদন্তকারীদের বিস্মিত করেছে চক্রটির আর্থিক লেনদেনের ধরন। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে করা হত কোটি কোটি টাকার লেনদেন। সাধারণের চোখ এড়াতে NGO-এর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেই টাকা ঢুকত ও বের হত। তিন বছর ধরে রাজ্যের একাধিক জেলায় ঘর ভাড়া নিয়ে থেকেছে অভিযুক্তরা। স্থানীয় দোকান থেকে কম দামে সিম কিনে তা পৌঁছে দিত মূল চক্রে। এই সময় কলকাতা, বর্ধমান, পানাগড় সব জায়গাতেই চলেছে তাদের নজরদারি।
বিপুল সিম কার্ড, একাধিক মোবাইল উদ্ধার, তথ্যের খোঁজে চলেছে জেরা
গ্রেফতারির পর অভিযুক্তদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে বিপুল পরিমাণ প্রি-অ্যাক্টিভেটেড সিম কার্ড, একাধিক মোবাইল, নকল নথিপত্র ও নগদ টাকা। ফরেন্সিক তদন্তে জানা গিয়েছে, ওই সিমগুলির একাংশে আগে থেকেই বিদেশি নম্বর যুক্ত ছিল। বর্তমানে এসটিএফ ওই মোবাইলগুলোর ডিজিটাল ফরেন্সিক পরীক্ষা চালাচ্ছে, যাতে জানা যায় আর কারা এই নেটওয়ার্কে যুক্ত ছিল। গোয়েন্দারা মনে করছেন, বাংলার বাইরে অন্য রাজ্যেও ছড়িয়ে রয়েছে এই চক্রের ডালপালা।
পাকিস্তান কানেকশন ঘিরে চাঞ্চল্য, তদন্তে নামতে পারে এনআইএ
এই ঘটনায় গোটা গোয়েন্দা মহলে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক চক্রান্তের গন্ধ পাচ্ছেন আধিকারিকরা। সূত্রের দাবি, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি ইতিমধ্যেই নজর রেখেছে গোটা ঘটনায়। প্রয়োজনে তদন্তভার তুলে দেওয়া হতে পারে জাতীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ-র হাতে। সেক্ষেত্রে আরও বিস্ফোরক তথ্য উঠে আসতে পারে আগামী দিনে।
চলবে আরও জেরা, ছড়ানো নেটওয়ার্ক গুঁড়িয়ে দিতে কোমর বেঁধেছে প্রশাসন
প্রাথমিক তদন্তে স্পষ্ট যে, এই চক্র শুধুমাত্র দু'জন ব্যক্তি চালাচ্ছিল না। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একটি পরিকাঠামোগত বিশাল নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্ক ভাঙতেই এখন চেষ্টার তুঙ্গে প্রশাসন। ধৃতদের রিমান্ডে নিয়ে চলছে গভীর জেরা। শীঘ্রই আরও গ্রেফতারি হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তদন্তকারীরা। গোটা রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে থাকা স্লিপিং সেল চিহ্নিত করাই এখন সরকারের কাছে চ্যালেঞ্জ।