হিমাচল প্রদেশের সুন্দর উপত্যকায় অবস্থিত পরাশর হ্রদ শুধু একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, বরং এমন একটি পবিত্র স্থান, যার নাম শুনলেই পৌরাণিক कथा ও ইতিহাস দুটোই একসঙ্গে মনে আসে। মান্ডি জেলা থেকে প্রায় ৪৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই হ্রদটি শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের দিক থেকেই মনোমুগ্ধকর নয়, এর সঙ্গে পাণ্ডব এবং ঋষি পরাশরের যোগও রয়েছে।
ঋষি পরাশরের তপোভূমি
পরাশর হ্রদের পাশে অবস্থিত প্রাচীন পরাশর মন্দির এই স্থানটিকে ধর্মীয় দিক থেকে আরও বিশেষ করে তোলে। ধারণা করা হয়, ঋষি পরাশর এই স্থানে কঠোর তপস্যা করেছিলেন। এই কারণেই আজও হ্রদের পাশে অবস্থিত এই মন্দিরটি ভক্তদের জন্য আস্থার কেন্দ্র হয়ে আছে।
এই মন্দিরটি ১৪শ শতাব্দীতে মান্ডি রাজ্যের রাজা বাণসেন নির্মাণ করেছিলেন। কাঠ দিয়ে তৈরি এই স্থাপত্য "কাঠকুনী" শৈলীতে নির্মিত, যা হিমাচলের ঐতিহ্যবাহী শিল্পের জীবন্ত উদাহরণ।
ভীমের কনুই দিয়ে তৈরি হ্রদের গর্ত?
এই হ্রদের সঙ্গে জড়িত সবচেয়ে আকর্ষণীয় গল্পটি হল, যখন পাণ্ডবরা অজ্ঞাতবাসে ছিলেন, তখন তাঁরা এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই সময় তাঁরা এখানে ঋষি পরাশরকে তপস্যা করতে দেখেন। ঋষিকে সম্মান জানাতে এবং তাঁর তপস্যার জন্য একটি শান্ত জায়গা করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ভীম তাঁর কনুই দিয়ে পাহাড়ে আঘাত করেন, যার ফলে এই হ্রদের সৃষ্টি হয়।
বলা হয়, হ্রদের আকার অস্বাভাবিক হওয়ার কারণ এটি মানুষের দ্বারা নয়, বরং মহাবীর ভীমের কনুই দ্বারা তৈরি হয়েছিল। এই কারণে এই হ্রদকে "ভীমের দ্বারা নির্মিত" হ্রদও বলা হয়।
হ্রদের রহস্য
পরাশর হ্রদের আরেকটি রহস্য হল, এর মাঝে একটি ছোট ভাসমান দ্বীপ রয়েছে, যা সময়ে সময়ে তার স্থান পরিবর্তন করে। বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে গবেষণা করেছেন, তবে আজও পর্যন্ত এর সঠিক কারণ জানা যায়নি যে কেন এই দ্বীপটি তার অবস্থান পরিবর্তন করে।
স্থানীয় লোকেরা বিশ্বাস করে যে এটি কোনো ঐশ্বরিক শক্তির ফল, আবার কারও মতে এটি ঋষি পরাশরের তপস্যারই ফলস্বরূপ।
কে ছিলেন ঋষি পরাশর
ঋষি পরাশর ভারতীয় বৈদিক ঐতিহ্যের মহান সাধুদের মধ্যে গণ্য হন। তিনি ঋষি বশিষ্টের পৌত্র এবং মুনি শক্তির পুত্র ছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি বেদব্যাসের পিতা হিসাবেও পরিচিত, যিনি মহাভারতের রচনা করেছিলেন।
পরাশর ঋষি সেইসব মহান ত্রিকালদর্শী সাধুদের মধ্যে একজন ছিলেন, যাঁদের ভবিষ্যৎ, বর্তমান এবং অতীত - এই তিন কালের জ্ঞান ছিল। তাঁর নামে পরাশর স্মৃতি এবং পরাশর সংহিতা-র মতো বহু গ্রন্থও বিখ্যাত।
হ্রদের সঙ্গে জড়িত মেলা ও উৎসব
প্রতি বছর পরাশর হ্রদের পাশে ঋষি পঞ্চমী, কাশী মেলা এবং সৌরানহুলি উৎসব খুব ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়। এই অনুষ্ঠানে শুধু স্থানীয়রাই নয়, আশেপাশের উপত্যকার দেবতারাও তাঁদের রথে চড়ে এই স্থানে আসেন।
এই মেলাগুলির সময় এই স্থানটি দেব সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে ওঠে, যেখানে ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র, লোকগান এবং ধর্মীয় রীতিনীতিগুলির ধ্বনি চারদিকে শোনা যায়।
হ্রদের গভীরতা এবং পরিবর্তনশীল ছায়া
পরাশর হ্রদের আরেকটি বিশেষত্ব হল, এর জল কখনও শুকিয়ে যায় না এবং এর গভীরতা আজও পর্যন্ত মাপা যায়নি। স্থানীয় বিশ্বাস অনুসারে, হ্রদের গভীরতা একটি অজানা রহস্য, যা কেউ বুঝতে পারেনি।
হ্রদের চারপাশে অবস্থিত পর্বতগুলির প্রতিবিম্ব যখন জলে পড়ে, তখন জলের রঙ পরিবর্তন হতে দেখা যায়। কখনও এটি নীল দেখায়, আবার কখনও সবুজ, যা এই হ্রদকে আরও রহস্যময় করে তোলে।
শত শত বছর ধরে টিকে আছে আস্থা
পরাশর হ্রদ শুধু একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, বরং এটি শত শত বছর ধরে মানুষের আস্থার কেন্দ্র হয়ে আছে। এখানে আসা মানুষেরা বিশ্বাস করেন যে, এই হ্রদে ডুব দিলে পাপ মোচন হয়। যদিও বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেন না, তবে যারা এখানে আসেন, তাঁরা এই স্থানের শক্তি এবং শান্তি থেকে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা লাভ করেন।