ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া ফের একবার আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়েছে। আমেরিকা ও ন্যাটো সেই সব দেশকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছে, যারা রাশিয়ার থেকে কম দামে তেল কিনছে। ভারত, যারা গত তিন বছর ধরে রাশিয়ার থেকে বিপুল পরিমাণে তেল কিনছে, তারা এখন কঠিন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুটের পক্ষ থেকে ভারত সহ চীন ও ব্রাজিলের উপর ১০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক চাপানোর হুমকি দেওয়া হয়েছে। এই হুঁশিয়ারি সরাসরি সেই দেশগুলোকে লক্ষ্য করে করা হয়েছে, যারা রাশিয়া থেকে তেল কিনে নিজেদের জ্বালানির চাহিদা পূরণ করছে।
ভারতকে রাশিয়ার থেকে সস্তা তেল কেনার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল
২০২২ সালে যখন ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয় এবং পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করে দেয়, তখন ভারত এই সুযোগ কাজে লাগায়। ভারত রাশিয়া থেকে অনেক ছাড়ে অপরিশোধিত তেল কেনা শুরু করে, যার ফলে দেশে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং অর্থনীতিও শক্তিশালী হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারত তার মোট জ্বালানির চাহিদার প্রায় ৮৫ শতাংশ অপরিশোধিত তেল আমদানির মাধ্যমে পূরণ করে এবং বর্তমানে রাশিয়া তার সবচেয়ে বড় তেল সরবরাহকারী দেশ হয়ে উঠেছে।
রাশিয়ার থেকে কেনা বন্ধ হলে কী প্রভাব পড়বে?
এখন যখন রাশিয়া থেকে তেল কেনার উপর ১০০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর হুমকি দেওয়া হয়েছে, তখন প্রশ্ন উঠছে ভারতের জ্বালানি নীতির উপর এর কী প্রভাব পড়বে। তেলমন্ত্রী হরদীপ সিং পুরী সম্প্রতি বলেছেন যে ভারত আমেরিকার হুমকিতে ভয় পায় না। তিনি এও জানান যে রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করে দিলে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১২০ থেকে ১৩০ ডলার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে, যা গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশও রাশিয়া থেকে তেল নিচ্ছে
ভারত একা নয়, যারা রাশিয়া থেকে তেল কিনছে। চীন, তুরস্ক এবং ব্রাজিলও রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি করছে। CREA-র একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারত রাশিয়া থেকে যত তেল কিনছে, তার থেকে বেশি চীন কিনছে। পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায়, রাশিয়ার প্রায় ৪৭ শতাংশ অপরিশোধিত তেল চীন নেয়, ৩৮ শতাংশ ভারত নেয়, যেখানে তুরস্ক এবং ইউরোপীয় দেশগুলোও তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে তেল কেনে। অর্থাৎ, পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়ার তেলের বাজার এখনও টিকে আছে।
ভারতের উপর কেন সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে?
ভারতের জন্য এই বিষয়টি আরও বেশি সংবেদনশীল, কারণ রাশিয়া এখন ভারতের সবচেয়ে বড় তেল সরবরাহকারী দেশ হয়ে উঠেছে। ২০২১-২২ সালে রাশিয়ার অংশ ছিল মাত্র ২.১ শতাংশ, কিন্তু ২০২৪-২৫ সাল পর্যন্ত তা ৩৫.১ শতাংশে পৌঁছে গেছে। অর্থাৎ, ভারত এখন তার তেলের চাহিদার এক তৃতীয়াংশের বেশি রাশিয়া থেকে পূরণ করে। যদি হঠাৎ করে এই সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে ভারতকে উপসাগরীয় দেশগুলো বা আমেরিকা থেকে বেশি দামে তেল কিনতে হবে, যার ফলে আমদানি বিল বাড়বে এবং মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে।
এটা কি ট্রাম্পের রণনীতি?
কিছু বিশেষজ্ঞের মনে করেন যে আমেরিকার এই হুঁশিয়ারি শুধুমাত্র রাশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করার কৌশল হতে পারে। ট্রাম্প আগেও রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। কিছু রিপোর্ট বলছে যে ট্রাম্প এবং পুতিনের মধ্যে ফোনে কথাবার্তা হয়েছে, যেখানে শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে রাশিয়া এখনও ইউক্রেনের উপর হামলা চালাচ্ছে। এমতাবস্থায়, সেকেন্ডারি স্যাংশনের হুমকিকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
তেলমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়ায় ভারতের অবস্থান স্পষ্ট হয়েছে
পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী হরদীপ পুরী স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে ভারত তার স্বার্থকে সবার উপরে রাখবে। তিনি বলেন যে বিশ্বের অর্থনীতি রাশিয়ার তেলের উপর নির্ভরশীল এবং ভারতের কেনাকাটা বিশ্ব বাজারে দাম স্থিতিশীল রেখেছে। তাঁর মতে, যদি ভারতও রাশিয়া থেকে তেল নেওয়া বন্ধ করে দেয়, তাহলে দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
বিশ্বের তেল সরবরাহের উপর প্রভাব পড়বে
যদি ভারত এবং চীনের মতো বড় ক্রেতারা রাশিয়া থেকে তেল নেওয়া বন্ধ করে দেয়, তাহলে বিশ্ব বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। বিশ্বে তেলের মোট সরবরাহের প্রায় ১০ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। যদি এই অংশটি বাজার থেকে गायब হয়ে যায়, তাহলে বাকি দেশগুলো সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে পারবে না এবং দাম আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে।
ট্রাম্পের হুঁশিয়ারিতে আমেরিকারও ক্ষতি?
যদি ভারত এবং চীনের উপর ১০০ শতাংশ ট্যাক্স लगाया जाता है এবং এই দেশগুলো আমেরিকা থেকে তেল কিনতে শুরু করে, তাহলে সেখানকার দামও বেড়ে যাবে। এতে আমেরিকার গ্রাহকদের ধাক্কা লাগতে পারে, যার রাজনৈতিক ক্ষতি ট্রাম্পকে বহন করতে হতে পারে। অনেক রিপোর্টে বলা হয়েছে যে ইউরোপের অনেক দেশ এখনও তৃতীয় দেশের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে তেল কিনছে, যা তাদের দ্বিচারিতা প্রকাশ করে।
তেলের খেলা এখন গ্লোবাল পলিটিক্সের অংশ হয়ে গেছে
আজকের দিনে অপরিশোধিত তেল শুধু জ্বালানির উৎস নয়, বরং রাজনৈতিক চাপের হাতিয়ারও হয়ে উঠেছে। একদিকে যেখানে রাশিয়া এটিকে তার বিরোধীদের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য ব্যবহার করে, অন্যদিকে আমেরিকা এবং ন্যাটোর মতো সংগঠনগুলো এটিকে শাস্তি দেওয়ার উপায় হিসেবে ব্যবহার করছে। ভারত এই পুরো খেলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়, যা শুধু নিজের প্রয়োজনই পূরণ করছে না, বরং বিশ্ব বাজারে তেলের ভারসাম্য বজায় রাখতেও ভূমিকা রাখছে।