আগে যেখানে হৃদরোগকে শুধুমাত্র বয়স্কদের রোগ হিসেবে গণ্য করা হতো, সেই রোগ এখন শিশুদেরও গ্রাস করছে। সম্প্রতি উত্তর প্রদেশে ৭ বছর বয়সী এক শিশুর স্কুল যাওয়ার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু, সকলকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়—গত কয়েক বছরে শিশুদের মধ্যে হৃদরোগ সংক্রান্ত সমস্যা দ্রুত বাড়ছে। এমতাবস্থায়, এই বিপদকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া এবং সময় থাকতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
বদলে যাওয়া জীবনযাত্রা: শিশুদের স্বাস্থ্যের সবচেয়ে বড় বিপদ
আজকের শিশুরা খেলাধুলার চেয়ে মোবাইল, টিভি এবং ট্যাবলেটের সাথে বেশি জড়িত থাকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রিনের সামনে বসে থাকা, বাইরের খেলার পরিবর্তে ঘরের মধ্যে সময় কাটানো এখন সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডাক্তারদের মতে, শারীরিক কার্যকলাপের অভাব শিশুদের মধ্যে স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরলের মতো রোগের কারণ হচ্ছে—যা পরবর্তীতে হৃদরোগে রূপ নিতে পারে।
একসময় শিশুদের জন্য পার্ক এবং খেলার মাঠে দৌড়ানোর সময় ছিল, সেই সময় এখন অনলাইন ক্লাস, গেমস এবং ভিডিও দেখার মধ্যে অতিবাহিত হয়।
খাবারে বিষাক্ত স্বাদ: জাঙ্ক ফুডের অভ্যাস
শিশুদের খাদ্যে পুষ্টির পরিবর্তে স্বাদ প্রাধান্য পাচ্ছে। পিৎজা, বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চিপস, কোল্ড ড্রিঙ্কস এবং মিষ্টি প্যাকেটজাত খাবার তাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। এই খাদ্যগুলি শুধু স্থূলতা বাড়ায় না, বরং শরীরে খারাপ কোলেস্টেরল জমা করে ধমনীকে সংকীর্ণ করে তোলে। এর ফলে হৃদপিণ্ডে রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হয় এবং এটিই পরবর্তীতে হৃদরোগের রূপ নিতে পারে।
চিকিৎসকদের মতে, শিশুদের বাড়িতে তৈরি, সুষম এবং পুষ্টিকর খাবার দেওয়াটাই এখন সবচেয়ে জরুরি।
পড়ালেখা এবং প্রতিযোগিতার ক্রমবর্ধমান চাপ: মানসিক চাপও একটি কারণ
আজকের শিক্ষাব্যবস্থা শিশুদের কাছ থেকে আরও বেশি ফলাফলের প্রত্যাশা করে। টিউশন, স্কুল, অনলাইন ক্লাস এবং প্রতিযোগিতার বোঝা শিশুদের মানসিক চাপে ফেলেছে। এছাড়াও, সোশ্যাল মিডিয়ার নেতিবাচক প্রভাব তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে।
মানসিক চাপ হরমোনের পরিবর্তন ঘটায়, যা হৃদস্পন্দনের অনিয়মিততা এবং হৃদয়ের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এটিও একটি বড় কারণ যে আজকাল অল্প বয়সেই হৃদরোগের ঘটনা ঘটছে।
বংশগত কারণ এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত অবহেলা
যদি কোনো পরিবারে আগে হৃদরোগের ইতিহাস থাকে, তবে শিশুদের মধ্যেও এই রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়াও, কিছু শিশুর জন্মগতভাবে হৃদরোগ সংক্রান্ত সমস্যা বা কোলেস্টেরল সম্পর্কিত জেনেটিক রোগ থাকতে পারে।
প্রায়শই এই পরিস্থিতি প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো উপসর্গ ছাড়াই দেখা যায়, তবে সময়মতো পরীক্ষা না করালে গুরুতর রূপ নিতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা—যেমন ব্লাড প্রেশার, লিপিড প্রোফাইল, ইসিজি এবং ইকো—শিশুদের জন্যও জরুরি, বিশেষ করে যখন পারিবারিক ইতিহাসে হৃদরোগের ইতিহাস থাকে।
শিশুদের হৃদরোগ থেকে বাঁচাতে এই ব্যবস্থা নিন
- সক্রিয় জীবনযাপন করুন: শিশুদের প্রতিদিন কমপক্ষে ৬০ মিনিট শারীরিক কার্যকলাপ (যেমন দৌড়ানো, খেলাধুলা, সাইকেল চালানো) করতে দিন।
- স্বাস্থ্যকর খাবার দিন: বাড়িতে তৈরি খাবার, সবুজ শাকসবজি, তাজা ফল, গোটা শস্য এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার তাদের খাদ্যতালিকায় যোগ করুন।
- স্ক্রিন টাইম সীমিত করুন: মোবাইল, টিভি এবং ল্যাপটপের ব্যবহার এক ঘণ্টার বেশি হতে দেওয়া উচিত না।
- পর্যাপ্ত ঘুম দিন: ৬-১২ বছর বয়সী শিশুদের জন্য ৯ থেকে ১১ ঘণ্টা এবং কিশোরদের জন্য ৮-১০ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন।
- মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগ দিন: যোগা, ধ্যান, প্রাণায়াম এবং খোলামেলা কথা বলার অভ্যাস শিশুদের মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান: বছরে একবার শিশুদের ব্লাড প্রেশার, সুগার, কোলেস্টেরল এবং বিএমআই পরীক্ষা করান। কোনো উপসর্গ দেখা দিলে দেরি করবেন না।
শিশুদের মধ্যে হৃদরোগের ক্রমবর্ধমান ঘটনা একটি গুরুতর সতর্কবার্তা যে এখন স্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলা করা চলবে না। সুষম খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম, কম স্ক্রিন টাইম এবং সময় মতো স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে শিশুদের এই মারাত্মক বিপদ থেকে বাঁচানো যেতে পারে। আজকের সতর্কতা তাদের ভবিষ্যৎকে নিরাপদ এবং সুস্থ করে তুলবে।