হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে শ্রাবণ মাস ভগবান শিবকে উৎসর্গ করা হয়। এই মাসটি শুধুমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং আত্মিক শান্তির অনুভূতিও প্রদান করে। ২০২৫ সালের শ্রাবণ মাস এখন তার শেষ পর্যায়ে, এবং চারপাশে শিব ভক্তির গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। মন্দিরে ঘণ্টার ধ্বনি, ওম নমঃ শিবায় মন্ত্রের জপ এবং গঙ্গা জল দিয়ে ভক্তদের অভিষেক একটি অলৌকিক পরিবেশ তৈরি করছে।
শিব হলেন সৃষ্টির মূল উৎস
ধর্মীয় গ্রন্থ এবং পুরাণগুলিতে শিবকে সংহারক বলা হয়েছে, তবে এটিও বলা হয়েছে যে সৃষ্টি, পালন এবং সংহার - তিনটি শক্তিই তাঁর থেকে উৎপন্ন হয়েছে। স্কন্দ পুরাণে উল্লেখ আছে যে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং রুদ্র - এই তিনজনই মহেশ্বরের অংশ। এর অর্থ হল শিবই সেই পরম সত্তার প্রতীক, যা থেকে এই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড উৎপন্ন হয়েছে।
শিবলিঙ্গের বিশেষ তাৎপর্য
শিবের নিরাকার রূপকে শিবলিঙ্গ রূপে পূজা করা হয়। এটি কেবল একটি প্রতীক নয়, বরং সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের উপস্থিতির চিহ্ন। শিবলিঙ্গের চারপাশে স্থিত জলহরি পুরো মহাবিশ্বকে ধারণ করার শক্তিকে নির্দেশ করে। এই কারণেই শিবকে অনাদি ও অনন্ত বলা হয়। যখন সময় ছিল না, সৃষ্টি ছিল না, তখনও শিব বিদ্যমান ছিলেন।
শ্রাবণে কেন শিব ভক্তি বেড়ে যায়
শ্রাবণ মাসে প্রকৃতিও ভক্তিময় হয়ে ওঠে। সবুজ শ্যামলিমা, ঠান্ডা বাতাস এবং ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সংমিশ্রণ ভক্তদের শিব ভক্তির দিকে আকর্ষণ করে। এই মাসে লোকেরা ব্রত রাখে, বেল পাতা নিবেদন করে, গঙ্গাজল দিয়ে শিবলিঙ্গের অভিষেক করে এবং ভোলেনাথকে সন্তুষ্ট করার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করে।
কাংওয়ার যাত্রার পবিত্র আয়োজন
শ্রাবণ মাসে লক্ষ লক্ষ ভক্ত কাংওয়ার নিয়ে গঙ্গাজল ভরতে হরিদ্বার, গঙ্গোত্রী, বারাণসী, দেওঘরের মতো তীর্থস্থানে যান। সেখান থেকে জল ভরে শিবমন্দিরে জলাভিষেক করেন। এই যাত্রা কেবল শারীরিক নয়, মানসিক ও আত্মিক সাধনারও মাধ্যম। ভক্তরা পায়ে হেঁটে শিবের নাম জপ করতে করতে যান এবং জীবনে আসা কষ্টগুলির সাথে লড়াই করার শক্তি অর্জন করেন।
শ্রাবণ সোমবারের বিশেষ মাহাত্ম্য
শ্রাবণ মাসের প্রতিটি সোমবার শিবের বিশেষ ব্রত রাখা হয়। মহিলারা ভালো স্বামী পাওয়ার জন্য এই ব্রত করেন, আর পুরুষরা তাদের জীবনে সাফল্য ও শান্তির জন্য শিবের উপাসনা করেন। এই দিনে শিব মন্দিরগুলিতে বিশেষ পূজা-অর্চনা হয়, রুদ্রাভিষেক করা হয় এবং শিব মন্ত্র জপ করা হয়।
ভক্তি ও প্রকৃতির মিলন
শ্রাবণে শিবের আরাধনা শুধু একটি ধর্মীয় কর্তব্য নয়, এটি ভক্তি, সাধনা এবং প্রকৃতির সাথে সংযোগ স্থাপনের সময়। এই মাসটি নিজের সাথে শান্তি, তপস্যা এবং সাধনার অনুভূতি নিয়ে আসে। যখন পৃথিবী সবুজের চাদর মুড়ে নেয়, তখন মনও শিবের ধ্যানে মগ্ন হয়ে যায়।
শ্রাবণে আত্মিক শক্তির সঞ্চার
এই পবিত্র মাসে শিবের পূজা করলে মানুষ কেবল জাগতিক সুখ লাভ করে না, নিজের মধ্যে এক নতুন শক্তির সঞ্চারও অনুভব করে। এই শক্তি তাকে আত্মার গভীরতা পর্যন্ত পৌঁছানোর পথ দেখায়। যখন মানুষ শিবের মধ্যে বিলীন হয়, তখন সে তার ভিতরে লুকানো আধ্যাত্মিক শক্তিকে চিনতে পারে।
অনাদিকাল থেকে চলে আসা ঐতিহ্য
শিব পূজার ঐতিহ্য বৈদিক যুগ থেকে চলে আসছে। ঋষিরা তাঁদের গ্রন্থে শিবকে যোগের আদিগুরু বলেছেন। শিবই সেই শক্তি, যিনি ধ্যানেও আছেন আবার নৃত্যেও। শিবের ভক্তিতে তাণ্ডবও আছে, আবার নীরবতাও। শ্রাবণ মাস এই অনুভূতিগুলি উপভোগ করার সুযোগ দেয়।
ধ্যান ও সংযমের সময়
শ্রাবণ শুধুমাত্র পূজা-অর্চনার মাস নয়, এটি সংযম ও শৃঙ্খলারও সময়। এই মাসে খাদ্য, আচরণ ও চিন্তাভাবনার মধ্যে পবিত্রতা বজায় রাখা হয়। এর ফলে জীবনে স্থিতিশীলতা আসে এবং মানুষ মানসিকভাবে আরও শক্তিশালী হয়।
ভক্তিতে ঝলক দেয় লোকসংস্কৃতি
শ্রাবণ মাস লোকগান, ভজন এবং শিব পার্বতীর বিবাহের গল্পের সাথে জড়িত কাহিনীতে ভরে ওঠে। গ্রামীণ অঞ্চলে শ্রাবণকে লোক উৎসব হিসেবেও পালন করা হয়। মহিলারা দোলনায় ঝোলে, গান গায় এবং শিবকে তাদের অনুভূতি দিয়ে খুশি করার চেষ্টা করে।
শ্রাবণ জীবনকে সরল ও ভক্তিময় করে তোলে
শ্রাবণ মাসের দিনগুলিতে মানুষ ভক্তির মাধ্যমে তাদের জীবনের সমস্যা থেকে উপরে ওঠার চেষ্টা করে। শিবকে সরল ও সহজ দেবতা হিসেবে মনে করা হয়, যাঁকে সত্য মনে ডাকলে তিনি তৎক্ষণাৎ প্রসন্ন হন। এই কারণেই শ্রাবণের প্রতিটি দিন একটি নতুন আধ্যাত্মিক অনুভূতি নিয়ে আসে।