শুল্কের কাঁটায় বিপর্যস্ত ভারতের পোশাক শিল্প

শুল্কের কাঁটায় বিপর্যস্ত ভারতের পোশাক শিল্প

বাংলাদেশ-ভিয়েতনামের তুলনায় প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে ভারত, অর্ডার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত রপ্তানিকারীদের মার্কিন বাজারে ধাক্কা ভারতের টেক্সটাইল শিল্পে

মার্কিন প্রশাসনের চাপানো বাড়তি শুল্কের কাঁটায় টালমাটাল ভারতের পোশাক ও টেক্সটাইল খাত। তিরুপুর, নয়ডা ও সুরাতের রপ্তানিকারীরা আপাতত মার্কিন অর্ডার তৈরি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁদের দাবি, ট্রাম্প প্রশাসন ভারতীয় পণ্যের উপর শুল্ক দ্বিগুণ করে ৫০ শতাংশ করায় অস্থিরতা বহুগুণ বেড়েছে। এর ফলে রপ্তানিকারী সংস্থাগুলি এখন ক্ষতির ভয়ে নতুন অর্ডার নেওয়া একপ্রকার বন্ধ করে দিয়েছে।

প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলির সুবিধা, ভারতের দুরবস্থা

শুল্কবৃদ্ধির ফলে ভারতীয় পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষত বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম এবং কাম্বোডিয়ার মতো দেশগুলি তুলনামূলকভাবে অনেক কম শুল্ক সুবিধা পাচ্ছে। মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের উপর শুল্ক মাত্র ২০ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া ও কাম্বোডিয়ার ক্ষেত্রেও প্রায় একই হার। ভিয়েতনামের ক্ষেত্রেও শুল্কের হার ২০ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ফলে ভারতীয় পোশাক মার্কিন বাজারে ক্রমশ ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে, আর ক্রেতারা ঝুঁকছেন প্রতিযোগী দেশগুলির দিকে।

তিরুপুর রপ্তানিকারীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ

তিরুপুর এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান এ শক্তিভেলের বক্তব্য অনুযায়ী, ভারতীয় রপ্তানিকারীরা অন্তত ৩০-৪০ দিন মার্কিন বাজারে কাজকর্ম স্থগিত রেখেছেন। তাঁর দাবি, শুল্কবৃদ্ধির জেরে ইউএস অর্ডার বানানো আর লাভজনক থাকছে না। ইতিমধ্যেই চলতি মাসে বিপুল অর্ডার বাতিল বা স্থগিত হয়ে গিয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে ক্ষতির অঙ্ক কোটি কোটি টাকায় গিয়ে পৌঁছবে। তিনি আরও বলেন, ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তিতে ইতিবাচক সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট কাটবে না।

রপ্তানি বন্ধে শ্রমজীবীদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার

কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির প্রাক্তন সভাপতি সঞ্জয় জৈন জানান, শুল্কবৃদ্ধির পর এখন রপ্তানি একেবারে বন্ধ রাখা হয়েছে। পুরনো অর্ডার ক্ষতি জেনেই পাঠাতে হচ্ছে, কিন্তু নতুন অর্ডার আসবে না বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে। ফলে, টেক্সটাইল ও পোশাক শিল্পের মতো শ্রমনির্ভর খাতে ব্যাপক বেকারত্ব দেখা দেওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। বিশেষ করে তিরুপুর ও নয়ডার মতো শহরে হাজার হাজার শ্রমিকের জীবিকা শঙ্কার মুখে।

প্রতিযোগিতায় দুর্বল ভারতের অবস্থান

বিশ্ববাজারে চীনের পরেই টেক্সটাইল ও পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনাম, ভারত ও বাংলাদেশের স্থান। সিআইটিআই চেয়ারম্যান রাকেশ মেহরার কথায়, দ্বিগুণ শুল্ক ভারতীয় রপ্তানিকারীদের জন্য ভয়ঙ্কর ধাক্কা। এমনিতেই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে ভারতের শিল্প খাত চলছিল। তার উপর এই অতিরিক্ত চাপ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ক্ষমতাকে একেবারে দুর্বল করে দিয়েছে। মার্কিন বাজার যেখানে ভারতের সবথেকে বড় গন্তব্য, সেখানে শুল্কবৃদ্ধি কার্যত রপ্তানি বাণিজ্যের মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের পোশাকের বিপণন সংকটে

ভারতে তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল পণ্যের সব থেকে বড় বাজার হল যুক্তরাষ্ট্র। এ বাজারেই এখন অচলাবস্থার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ক্রেতারা কম দামের বিকল্প হিসেবে ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশকে বেছে নিচ্ছেন। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, আমেরিকায় ৫০ শতাংশ শুল্কের বোঝা নিয়ে পণ্য পাঠানো একপ্রকার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। ফলে বাজার ধরে রাখার চেষ্টায়ও এখন অসহায় বোধ করছেন তাঁরা।

বিকল্প বাজারের খোঁজে ভারত

ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি যে দীর্ঘমেয়াদে ভারতের শিল্পের জন্য বিপজ্জনক হতে চলেছে, তা এখন স্পষ্ট। তাই ভারতীয় ব্যবসায়ী মহল ইতিমধ্যেই বিকল্প বাজারের দিকে নজর দিচ্ছে। সিআইটিআই সূত্রে খবর, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার অন্তত ৪০টি দেশের বাজারে প্রবেশের রূপরেখা তৈরি করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই—মার্কিন চাপ থেকে মুক্তি পেয়ে রপ্তানির নতুন দিগন্ত খুঁজে বের করা। তবে এ প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ এবং ঝুঁকিপূর্ণ বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।

সাম্প্রতিক তথ্য: রপ্তানির পতন স্পষ্ট

সিআইটিআই-এর সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, টানা তিন মাস ধরে ভারতের টেক্সটাইল ও পোশাক রপ্তানি কমেছে। যদিও বার্ষিক হিসাবে ৩.৩ শতাংশ বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, তবে এপ্রিল মাসে শুল্কবৃদ্ধির ঘোষণার পর থেকেই পতন শুরু হয়েছে। বছরের প্রথম তিন মাসে রপ্তানি ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ হারে বেড়েছিল, কিন্তু এরপরেই ধাক্কা খেয়ে মন্দার পথে নেমে গেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আগামী কয়েক মাস পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে যদি মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনায় ইতিবাচক ফলাফল না আসে।

শিল্পের সামনে অনিশ্চয়তার ঘনঘটা

সারকথা, মার্কিন শুল্কবৃদ্ধি ভারতের টেক্সটাইল ও পোশাক শিল্পকে এক গভীর সঙ্কটে ঠেলে দিয়েছে। প্রতিযোগী দেশগুলির সুবিধাজনক অবস্থান, রপ্তানিকারীদের অর্ডার বন্ধের সিদ্ধান্ত, শ্রমিকদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এখন দেখার, ভারত সরকার কত দ্রুত কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্তরে সমাধান খুঁজে পায়, আর শিল্পমহল কতটা সফলভাবে বিকল্প বাজার তৈরি করতে পারে। না হলে বিশ্বের অন্যতম বড় পোশাক উৎপাদনকারী দেশ হয়েও ভারত ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়বে প্রতিযোগিতার ময়দানে।

 

Leave a comment