শুরুর সংগ্রাম: শৈশবেই জীবনের কঠোর পাঠ
কিছু মানুষের জীবন শুরু হয় অন্যদের চেয়ে অনেক কঠিনভাবে। বি. আব্দুল নাসারের শৈশব সেই ধরনের। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পর, মা একের পর এক দিনভর অন্যের বাড়িতে ঘর পরিষ্কারের কাজ করে সংসার চালানোর চেষ্টা করতেন। কিন্তু তা তাদের পরিবারের জন্য যথেষ্ট ছিল না। ১৩ বছর কেরলের অনাথ আশ্রমে কাটিয়ে নাসার এবং তার ভাইবোনরা জীবনের প্রথম বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। এই আশ্রমই হয়ে ওঠে তাদের মাথা গোঁজার একমাত্র ঠিকানা, যেখানে নাসার শিখেছিলেন ধৈর্য, মনোবল এবং আত্মনির্ভরতার মর্ম।
শৈশবের কষ্ট: খেলাধুলা নয়, জীবনধারার সংগ্রাম
নাসারের ভাগ্যে শৈশবের খেলাধুলা ছিল না। মাত্র দশ বছর বয়সে ক্লিনার এবং ডেলিভারি বয়ের কাজ শুরু করতে হয় তাকে। কাজের পাশাপাশি তিনি পড়াশোনাও চালিয়ে যান। বড় হতে হতে আরও কাজ যোগ হয়—খবরের কাগজ পৌঁছে দেওয়া, অন্যান্য ছাত্রদের টিউশন দেওয়া এবং ফোন অপারেটর হিসেবে কাজ করা। প্রতিটি কাজই ছিল তার বিল মেটানোর একটি উপায়। এই অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছিল সময় ব্যবস্থাপনা, দায়িত্ব এবং আত্মনির্ভরতার মূল্য।
প্রাথমিক চাকরি: স্থিতিশীলতা নয়, লক্ষ্য নির্ধারণ
নাসারের প্রথম সরকারি চাকরি শুরু হয় রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য পরিদর্শক হিসেবে। অনেকের কাছে এটি একটি স্থিতিশীল ও সম্মানজনক পেশা। কিন্তু নাসারের কাছে এটি ছিল কেবল একটি প্রারম্ভিক ধাপ। ইউপিএসসি পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট অর্থ এবং কোচিং সুবিধা না থাকায় তিনি ভিন্ন পথ বেছে নেন। তিনি রাজ্যের নিজস্ব প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে অগ্রগতির চেষ্টা চালিয়ে যান, প্রতিটি পদে সেরা হওয়ার সংকল্প নিয়ে।
কঠোর পরিশ্রমের প্রতিফলন: কেরল পিএসসি-তে সাফল্য
নাসারের অবিরাম পরিশ্রম এবং নিষ্ঠার ফল আসে যখন তিনি কেরল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই পরীক্ষাও ছিল অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। ২০০৬ সালে তিনি ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে রাজ্য সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। তার সাফল্য প্রমাণ করে যে, সঠিক মনোভাব, কঠোর পরিশ্রম এবং ধৈর্য দিয়ে অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়।
দক্ষতা ও সেবায় প্রতিভা: বছর বছর অর্জন
ডেপুটি কালেক্টর পদে যোগদানের পর, নাসার নিজের দক্ষতা দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে তিনি কেবল চাকরিতে সীমাবদ্ধ নয়। বছরের পর বছর ধরে তিনি অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেছেন এবং জনগণের সেবায় অনন্য রেকর্ড তৈরি করেছেন। আইএএস নিয়ম অনুযায়ী তার ব্যতিক্রমী কর্মক্ষমতার কারণে তিনি পদোন্নতি পান। ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত কোল্লামের জেলা কালেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বর্তমানে কেরল সরকারের মৎস্য বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সিস্টেমের মধ্যেই স্বপ্নপূরণ: কঠোর পরিশ্রমের মন্ত্র
নাসারের গল্পের সবচেয়ে অনুপ্রেরণামূলক দিক হলো—তিনি প্রচলিত পরীক্ষার মাধ্যমে নয়, বরং সিস্টেমের মধ্যেই নিজের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে স্বপ্ন পূরণ করেছেন। এটি প্রমাণ করে যে প্রতিভা সর্বত্র আছে, কিন্তু সুযোগ সব সময় সমান নয়। তার পথের জন্য প্রয়োজন ছিল কয়েক দশকের ধৈর্য, এবং সেটি সম্ভব হয়েছিল শৈশবের সংগ্রামের মাধ্যমেই।
অনুপ্রেরণার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত
বি. আব্দুল নাসারের জীবন আমাদের শেখায় যে, জীবন যেখানেই শুরু হোক না কেন, অধ্যাবসায়, নিষ্ঠা এবং সঠিক দিকনির্দেশনায় সবকিছু সম্ভব। অনাথ আশ্রম থেকে শুরু করে কেরল সরকারের মৎস্য বিভাগের সচিব হওয়া, তার যাত্রা আমাদের বোঝায়—সঠিক মানসিকতা এবং নিরলস পরিশ্রমে বড় স্বপ্নও পূরণ করা যায়। আজ তার গল্প কেবল সাফল্যের প্রতীক নয়, বরং এক অনুপ্রেরণার অমোঘ উৎস।